শিশুদের বার করে দিয়ে অঙ্গনওয়াড়ির ঘরে বসেছে ক্লাবের ছেলেদের টিভি দেখার আসর। খিদিরপুরের ভূকৈলাস রোডে। —নিজস্ব চিত্র।
মোমিনপুর বাজার এলাকায় সরু গলির ভিতরে একচিলতে ঘরের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। জনা পঁয়ত্রিশ শিশু প্রতিদিন সেখানে আসে। এলাকার একটি ক্লাবের ঘর ভাড়া নিয়ে কেন্দ্রটি চলে। ঘরের সঙ্গে একটি শৌচাগার ছিল। কিন্তু অভিযোগ, বছর দুই আগে সেটি এলাকার অন্য একটি পরিবার দখল করে নিয়েছে। অর্থাৎ, অতগুলি শিশু এবং অঙ্গনওয়াড়ির মহিলা কর্মী ও সহায়িকা যত ক্ষণ কেন্দ্রে থাকেন, তত ক্ষণ শৌচাগার ব্যবহার করতে পারেন না। পানীয় জলেরও কোনও সরবরাহ নেই।
সেই অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে ঢোকার যে দরজা, তার এক দিকে চলছে খাটাল। পলিথিন দিয়ে সামনেটা ঢাকা। স্থানীয় হোটেলের অতিরিক্ত গ্যাস সিলিন্ডারগুলি বেআইনি ভাবে মজুত করা হয়েছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের ঘুপচি ঘরে। বাচ্চারা সেখানে থাকাকালীন যে কোনও সময়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
খিদিরপুরের ভূকৈলাস রোডে আর একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র। প্রায় ৫৫টি শিশু রোজ আসে। সেটিও চলে একটি ক্লাবের ঘর ভাড়া করে। শৌচাগার বা পানীয় জলের কোনও ব্যবস্থা নেই। ঘরের চাল ফুটো। বৃষ্টি হলে কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হয়। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, শিশুদের এবং অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মীদের সে দিনের মতো ঘর থেকে বার করে দিয়ে সেখানে বসে টিভি দেখছেন ক্লাবের প্রতাপশালী সেক্রেটারি এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা! বাচ্চারা তত ক্ষণে বাড়ি চলে গিয়েছে। মহিলা কর্মীরা গালে হাত দিয়ে বাইরে বসে আছেন।
কলকাতা জুড়ে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিতে নানা রকম দুর্নীতি, অনিয়ম, নজরদারি ও পরিকাঠামোর অভাবের কথা উঠে এসেছে সমাজকল্যাণ দফতরের সমীক্ষাতেই।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত সেই সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, কলকাতায় চলা ১৫১৬টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের মধ্যে ৮০৫টিতে শৌচাগারই নেই। চার-পাঁচ-ছয় বছরের শিশুরা টানা চার-পাঁচ ঘণ্টা শৌচাগারে যেতে পারে না। তাই বহু জায়গায় তারা আসেই না। বা এসে শুধু খিচুড়িটুকু নিয়ে বাড়ি চলে যায়। খাবারের ক্ষেত্রেও বহু অনিয়মের অভিযোগ। অনেক জায়গায় কেন্দ্রে রান্না না-করে সহায়িকা বাড়ি থেকে রান্না করে আনছেন। বাজারের টাকা ও চাল চলে যাচ্ছে তাঁর বাড়িতে। তার কতটুকুর সদ্ব্যবহার হচ্ছে, কত জন শিশু খাচ্ছে, সে ব্যাপারে কোনও নজরদারি নেই। পানীয় জলের ফিল্টারেরও বালাই নেই কোথাও। বাগবাজার, বেলেঘাটা, ভবানীপুর, বড়তলা, গার্ডেনরিচ, খিদিরপুর, তিলজলা— কোথাও এমন অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র পাওয়া মুশকিল, যেখানে শৌচাগার রয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বড়তলার আটটি কেন্দ্র এবং কলকাতার এক যৌনপল্লি এলাকার দু’টি কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
কলকাতায় অঙ্গনওয়াড়ি নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার সমীক্ষায় উঠে এসেছে আরও মারাত্মক তথ্য। দেখা গিয়েছে, আলিফনগর এলাকার প্রায় ১৫০টি শিশু, ব্রুকলিন কোয়ার্টার্স এলাকার প্রায় ৪০০টি শিশু, হেস্টিংস স্ট্রিটের প্রায় ২০০টি শিশু এবং ই জে সি ডক জংশনের প্রায় ১৫০ শিশু এখনও অঙ্গনওয়াড়ির আওতাতেই আসেনি। অথচ, মূলত শহরের বস্তি এলাকার শিশু বা পথশিশুদের পুষ্টি ও প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার ভরসা হওয়ার কথা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের। এই রিপোর্ট ডিসেম্বরে সমাজকল্যাণ দফতরে জমা পড়েছে। তা নিয়ে বৈঠকও হয়েছে।
রাজ্যের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজার কথায়, ‘‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় ক্লাবের ঘর ভাড়া করে কেন্দ্র চালাতে হচ্ছে। টাকা নিয়েও তারা সুবিধা দিচ্ছে না। কলকাতায় দফতরের নিজস্ব বাড়ি বা জমি না থাকায় আমরাও পরিকাঠামো তৈরি করে নিতে পারছি না।’’ অঙ্গনওয়াড়ির বিভিন্ন কেন্দ্রে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তা ছাড়া, বহু শিশু এখনও এই প্রকল্পের বাইরেই থেকে গিয়েছে। এ নিয়ে শশীর মন্তব্য, ‘‘বিষয়টি শুনেছি। উদ্বেগজনক। খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আসলে অঙ্গনওয়াড়ির কাজ নজরদারির জন্য তৈরি কমিটিগুলি দায়িত্ব পালন করছে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy