Advertisement
০১ এপ্রিল ২০২৩

অ্যাবাকাসে বিশ্বসেরা কলকাতার কিশোরী

সময়টা ১৯৩২। তিন বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে রাস্তায় অঙ্কের খেলা, তাসের খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন বাবা। অবলীলায় মুখে মুখে কঠিন অঙ্কের সমাধান করে ফেলত মেয়েটি, কোনও প্রশিক্ষণ ছাড়াই। বড় হয়ে মেয়েটি পরিচিত হয়েছিলেন ‘‘মানব-কম্পিউটার’’ হিসেবে। তিনি বেঙ্গালুরুর শকুন্তলা দেবী।

মৌবনী সরকার। — নিজস্ব চিত্র

মৌবনী সরকার। — নিজস্ব চিত্র

মধুরিমা দত্ত
শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০১৬ ০০:৪৭
Share: Save:

সময়টা ১৯৩২। তিন বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে রাস্তায় অঙ্কের খেলা, তাসের খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন বাবা। অবলীলায় মুখে মুখে কঠিন অঙ্কের সমাধান করে ফেলত মেয়েটি, কোনও প্রশিক্ষণ ছাড়াই। বড় হয়ে মেয়েটি পরিচিত হয়েছিলেন ‘‘মানব-কম্পিউটার’’ হিসেবে। তিনি বেঙ্গালুরুর শকুন্তলা দেবী।

Advertisement

বাঘা যতীনের বাসিন্দা মৌবনী সরকারের অবশ্য প্রশিক্ষণ লেগেছে। ৫৭টি দেশকে হারিয়ে প্রথম হতে তালিমও লেগেছে যথেষ্ট। চিনের গণনা পদ্ধতি অ্যাবাকাসের এক প্রতিযোগিতায় সাড়ে এগারো হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে সেরার মুকুট উঠেছে বালিগঞ্জ শিক্ষা সদনের নবম শ্রেণির এই পড়ুয়ার মাথায়। ইউসিমাস নামে একটি সংস্থা আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় ২০০টি অঙ্ক কষতে মৌবনী সময় নেয় মাত্র আট মিনিট। মুখে মুখে বড় গণনা করতে সময় নেয় কয়েক সেকেন্ড।

‘‘অঙ্ক করতে ঠিক কবে থেকে ভালোবাসি মনে নেই, তবে এখন বুঝি অন্য বিষয়ের থেকে অঙ্কই আমার বেশি পছন্দের। কারণ, অঙ্ক কষতে কষতে গান শোনা যায়,’’ ঘর ভর্তি শংসাপত্র এবং ট্রফির মধ্যে বসে জানায় মৌবনী। সাধারণত অঙ্ক নিয়ে গড়পড়তা পড়ুয়াদের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে। সেখানে এমন ব্যতিক্রমী প্রতিভার পিছনে কারণটা ঠিক কী? শ্রীনিবাস রামানুজম থেকে শুরু করে বশিষ্ঠ নারায়ণ সিংহ— অঙ্কের দিগ্‌গজদের তালিকা নেহাত মন্দ নয়। কিন্তু ব্যতিক্রমের কারণ হিসেবে নির্দিষ্ট কোনও পথ বাতলাতে পারেননি কেউই।

মাথার ব্যাপার সব সময়েই জটিল। সেখানে কখন, কী ভাবে কাজ হয় তা ব্যাখ্যা করা দায়— জানান এক চিকিত্সক। মাথার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট স্নায়ু পথে গণনার কাজ হয়। কিছু মানুষের এই পথ এমন ভাবে তৈরি হয় যে, তাঁরা সংখ্যা, গণনা সব কিছু অন্য ভাবে ‘প্রসেস’ করেন। কারও স্নায়ু পথ আবার প্রয়োজনের তুলনায় কম কাজ করায় ‘অটিজম’ লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু শিশু বয়সে যত দ্রুত এই প্রসেসিং হয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা কমে যায় বহু ক্ষেত্রেই। ব্যাপারটা অনেকটা বিদ্যুতের সার্কিটের মতো। ছোটবেলায় তাতে চাপ কম, গতি বেশি থাকে। বিদ্যুতের সার্কিটে যত অন্য সংযোগ এসে জোড়ে, স্বাভাবিক ভাবেই গতিপথে চাপ বাড়ে। মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেও এমনটাই হয়, জানান শারীরবিদ্যার অধ্যাপক তুষার ঘোষ। ব্যতিক্রমের কারণ ঠিক কী, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না মনোবিজ্ঞানী মোহিত রণদীপও।

Advertisement

পরীক্ষা শুরুর আধঘণ্টার মধ্যেই সব অঙ্ক করে ফেলতেন তামিলনাড়ুর শ্রীনিবাস রামানুজম, মুখে মুখেই বড়বড় অঙ্কের উত্তর কষে তাজ্জব করে দিতেন শকুন্তলা দেবী। কিন্তু এত দ্রুত গণনার ফলে কী স্নায়ুতে কোনও চাপ পড়ে? অঙ্কের দিক্‌পাল বিহারের বশিষ্ঠ নারায়ণ সিংহ এবং গেম থিওরির আবিষ্কর্তা জন ন্যাশ— এই দুই গণিতবিদই আক্রান্ত হয়েছিলেন স্কি‌ত্‌জোফ্রেনিয়া রোগে। অনেকেই এর সঙ্গে দ্রুত গণনার ফলে স্নায়ুর চাপের একটা যোগসূত্র খুঁজে পেলেও মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম বলেন, ‘‘এটি নেহাতই কাকতালীয়। দ্রুত গণনায় মস্তিষ্কের উপরে কোনও বিরূপ প্রভাব পড়ে না।’’ তিনি আরও জানান, কারও কারও ব্যতিক্রমী ক্ষমতা থাকে। আমরা সাধারণত দ্বিমাত্রিক ছবি আঁকি। কিন্তু কেউ কেউ খুব সহজেই ত্রিমাত্রিক ভাবে সেই ছবিটা আঁকতে পারেন। কারণ তাঁরা ত্রিমাত্রিক ভাবে ভাবতেও পারেন।

ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ক্রিকেটারদের যেমন চোখ এবং হাতের মধ্যে এক অদ্ভুত সমন্বয় কাজ করে। কত গতিতে বল আসছে, বা ঠিক কখন, কী ভাবে ব্যাট চালালে রান হবে, পুরোটাই তাঁদের মাথা খুব দ্রুত ভেবে নিতে পারে। ফলে রূপায়ণও হয় দ্রুত।’’ এই ব্যতিক্রমী প্রতিভার পিছনে বংশপরম্পরা, জেনেটিক কোডিংয়ের কী প্রভাব, তা নিয়ে গবেষণা চলছে বিস্তর। সেরার সম্মান পেয়েও অবশ্য আক্ষেপ রয়েছে মৌবনীর। তার কথায়, ‘‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলেও অঙ্ক পরীক্ষায় একশোয় একশো মেলে না।’’ সে ক্ষেত্রে মনোবিদদের একাংশের ব্যাখ্যা, অ্যাবাকাস নিছকই একটা গণনা পদ্ধতি। তার সঙ্গে অঙ্কশাস্ত্রে তুখোড় হওয়ার কোনও সম্বন্ধ নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.