Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পেশাদারি মনোভাবেই এগিয়ে লাক্সারি ক্যাব

কলকাতায় দীর্ঘদিন ধরেই ট্যাক্সি চালাতেন রামপ্রসাদ সাউ। পথঘাটে যাত্রী প্রত্যাখ্যানে তাঁর নাম একাধিক বার পুলিশের খাতায় উঠেছে। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে গাড়ির মালিকের গঞ্জনাও শুনতে হয়েছে রামপ্রসাদকে।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৫ ০৩:০৯
Share: Save:

কলকাতায় দীর্ঘদিন ধরেই ট্যাক্সি চালাতেন রামপ্রসাদ সাউ। পথঘাটে যাত্রী প্রত্যাখ্যানে তাঁর নাম একাধিক বার পুলিশের খাতায় উঠেছে। তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে গাড়ির মালিকের গঞ্জনাও শুনতে হয়েছে রামপ্রসাদকে।

সম্প্রতি ট্যাক্সি চালানোর কাজ ছেড়ে ব্যাঙ্ক ঋণে একটি দামি গাড়ি কিনেছেন তিনি। যোগ দিয়েছেন একটি ‘ক্যাব’ পরিষেবা সংস্থায়। চালক হিসেবে যাত্রীদের সঙ্গে ভাল ব্যবহারে তাঁর ‘রেটিং’ ক্রমশই ঊর্ধ্বমুখী।

রামপ্রসাদ নেহাতই একটি চরিত্র। আদতে হলুদ ট্যাক্সি ছেড়ে লাক্সারি ট্যাক্সি চালাতে গিয়ে এমন ভাবেই বদলে যাচ্ছে অনেক ট্যাক্সিচালকদের ব্যবহার। শহরের বাসিন্দারা বলছেন, এই ভাল ব্যবহার আর প্রত্যাখ্যান না করার জোরেই প্রতিযোগিতায় নতুন ‘ক্যাব’ পরিষেবা হারিয়ে দিচ্ছে হলুদ ট্যাক্সিকে। প্রশ্ন উঠেছে, প্রতিযোগিতার বাজারে তা হলে ট্যাক্সি কেন বদলায় না? কেন এখনও ট্যাক্সি ধরতে গেলেই মেলে প্রত্যাখ্যান?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে প্রথমেই যে তত্ত্বটা মিলছে, তা হল পেশাদারি সংস্থার পরিচালন ব্যবস্থা। ট্যাক্সিচালকেরা অনেক সময়েই নিজেরা মালিক। প্রত্যাখ্যান করলেও মালিকের কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না। কিন্তু ক্যাব পরিষেবা সংস্থার গাড়ি বুকিং থেকে বিল তৈরি, চালক ঠিক মতো পৌঁছচ্ছেন কি না বা কেমন ব্যবহার করছেন— পুরোটাই থাকে সংস্থার ‘কন্ট্রোল রুমের’ নজরদারিতে। তার ফলে চালকের নিজের মর্জিমাফিক চলার উপায় থাকে না। কিন্তু এটাই কি সব?

‘ক্যাব’ পরিষেবা সংস্থার চালকেরা বলছেন, সাধারণ ট্যাক্সির সঙ্গে পেশাদার সংস্থার ‘ক্যাব’-এর অর্থনৈতিক ফারাকও রয়েছে। ‘ক্যাব’-এর ক্ষেত্রে যাত্রীরাই নিজের প্রয়োজনে ডেকে নেবেন গাড়ি। ফলে খালি গাড়ি নিয়ে যাত্রী খোঁজার দায় নেই। প্রত্যাখ্যানকে স্বীকৃতি দিতে এই অর্থনৈতিক তত্ত্বকেও ঢাল করছেন অনেক ট্যাক্সিচালক। তাঁরা বলছেন, কোনও যাত্রী ধর্মতলা থেকে গড়িয়া যাবেন। তাঁকে পৌঁছে দেওয়ার পরে পরের যাত্রীকে খুঁজতে হবে। সেই যাত্রী খোঁজার জন্য তাঁকে খালি গাড়ি নিয়ে হয়তো গড়িয়াহাট কিংবা যাদবপুরে আসতে হবে। তার ফলে যে জ্বালানি খরচ হবে, সেটাই চালক ভাড়ার অতিরিক্ত হিসেবে দাবি করেন। একটি ট্যাক্সিচালক সংগঠনের নেতা বলছেন, ‘‘যাদবপুরে এসে যদি ফের কোনও গড়িয়ার যাত্রী মেলে, তা হলে ট্যাক্সিচালক প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, সেখানে যাত্রীর অভাবে ফের ফাঁকা গাড়ি চালিয়ে যাদবপুরে আসতে হবে।’’ কিন্তু ট্যাক্সিচালকদের এই সমস্যার দায় কেন যাত্রীর উপরে বর্তাবে, তার কোনও সদুত্তর নেই।

‘ক্যাব’ চালকদের অনেকে বলছেন, যাত্রী খোঁজার দায় তাঁদের না থাকলেও এক জায়গা থেকে সব সময়ে যাত্রী মিলবে, এমনটা হয় না। ধরা যাক, ‘ক্যাব’ নিয়ে কেউ গড়িয়া গিয়েছেন। যাত্রী নামানোর পরে তিনি সেখানেই ঘাঁটি গাড়বেন, এমনটা হয় না। বরং গড়িয়াহাটে যদি গাড়ির চাহিদা বেশি থাকে, তা হলে ‘কন্ট্রোল’ থেকে তাঁকে গড়িয়াহাট পৌঁছনোর নির্দেশ দেওয়া হবে। ‘‘মাঝপথে আমি কোনও যাত্রী পেলেও তুলতে পারব না। হলুদ ট্যাক্সির কিন্তু সেই বাধা নেই,’’ বলছেন এক ক্যাবচালক।

তা হলে সমস্যাটা কোথায়?

শহরের বাসিন্দাদের অনেকেই বলছেন, এটা মানসিকতার প্রশ্ন। ক্যাব সংস্থায় যোগ দিলেই পেশাদারি মানসিকতা গড়ে দেওয়া হয়। কাজের বিনিময়ে মেলে ‘ইনসেন্টিভ’। আর দুর্ব্যবহার করলে কমে যেতে পারে আয়। ফলে চালকেরা ব্যবহার ভাল করতে কার্যত বাধ্য থাকেন। পরিষেবার ক্ষেত্রে ব্যবহার একটা বড় জিনিস। তা দিয়েই প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকে সংস্থাগুলি। কিন্তু এই সূত্র মেনে কলকাতার ট্যাক্সিচালকদের মানসিকতা বদলায়নি। দিন কয়েক আগেই যার প্রমাণ পেয়েছেন বাগুইআটির এক যুবক। স্ত্রী, শিশুপুত্র এবং কোলের কন্যাসন্তানকে নিয়ে রবীন্দ্র সদনের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। একের পর এক ট্যাক্সি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছে। শেষে কার্যত হাতেপায়ে ধরে এক ট্যাক্সিচালককে রাজি করান তিনি। বাগুইআটি যেতে নির্দিষ্ট ভাড়ার থেকে ৫০ টাকা বেশি গুনতে হয়েছে তাঁকে।

প্রত্যাখ্যানের এই বেপরোয়া মনোভাবের জন্যই হলুদ ট্যাক্সিকে পাল্টা প্রত্যাখ্যানের সাহস দেখাচ্ছেন অনেকে। যেমন করেছেন কসবার বাসিন্দা এক প্রৌঢ়। গত সপ্তাহেই রাত ন’টা নাগাদ ধর্মতলার মোড় থেকে বাড়ি ফেরার জন্য ট্যাক্সি ধরতে গিয়েছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা, ট্যাক্সিচালক ভাড়ার চেয়ে ৩০ টাকা বেশি চেয়েছিলেন। শুনেই পাল্টা প্রত্যাখ্যান করেন ওই প্রৌঢ় এবং পকেট থেকে মোবাইল ফোন বার করে অ্যাপের মাধ্যমে ‘ক্যাব’ বুক করতে গিয়েছিলেন। এ কথা বেশ চিৎকার করে শুনিয়েওছিলেন তিনি। চিৎকার শুনেই পিছন থেকে এক ট্যাক্সিচালক এসে তাঁকে গাড়িতে উঠতে বলেন। মিটারের থেকে এক পয়সাও বেশি চাননি ওই চালক। ওই প্রৌঢ় বলছেন, ‘‘যাত্রীরাও যে এখন পাল্টা প্রত্যাখ্যান করতে পারেন, এটা ওই চালক বুঝতে পেরেছিলেন।’’

কিন্তু এই সারসত্যটা বেশির ভাগ ট্যাক্সিচালক কবে বুঝবেন, সেই প্রশ্নটা কিন্তু রয়েই যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE