Advertisement
০৫ মে ২০২৪

রূপাকে কেন গ্রেফতার নয়, বিস্ময় বাড়ালো মমতার প্রশ্ন

গোপালনগরে গোলমালের ঘটনায় বুধবারই রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে শাসকদলের অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর নামে খুনের চেষ্টার মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। আর বৃহস্পতিবার কার্যত রূপাকে গ্রেফতার করার পক্ষে সওয়াল করলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! এ দিন কলকাতায় পুরসভা ভোট-প্রচারের শেষ লগ্নে সন্তোষপুরের সুকান্ত সেতু থেকে ‘রোড শো’ শুরু করার আগে মঞ্চে ওঠেন মমতা। মঙ্গলবার বিজেপির সভায় রূপার সঙ্গে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের সংঘাতের কথা নিজেই পাড়েন তিনি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪৩
Share: Save:

গোপালনগরে গোলমালের ঘটনায় বুধবারই রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে শাসকদলের অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর নামে খুনের চেষ্টার মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। আর বৃহস্পতিবার কার্যত রূপাকে গ্রেফতার করার পক্ষে সওয়াল করলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!

এ দিন কলকাতায় পুরসভা ভোট-প্রচারের শেষ লগ্নে সন্তোষপুরের সুকান্ত সেতু থেকে ‘রোড শো’ শুরু করার আগে মঞ্চে ওঠেন মমতা। মঙ্গলবার বিজেপির সভায় রূপার সঙ্গে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের সংঘাতের কথা নিজেই পাড়েন তিনি। এবং রূপার নাম না-করে বলেন, ‘‘অন্যায় করলে যে কোনও দলের লোকই অ্যারেস্ট হবেন। তা হলে যাঁরা আমাদের দলের ফ্ল্যাগকে পিষে মাড়িয়ে দিলেন, তাঁরা কেন অ্যারেস্ট হবেন না?’’ তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের অভিযোগ, সে দিন তাঁদের দলের পতাকা খুলে পা দিয়ে মাড়িয়েছেন রূপা।

এ দিনই বিকেলে উলুবেড়িয়া পুরসভার ডোমপাড়ার জনসভায় রূপার বিরুদ্ধে তৃণমূলের পতাকা ছেঁড়ার অভিযোগ এনে তাঁকে গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। ঘটনাচক্রে এ দিনই উলুবেড়িয়ায় সভা করতে যান রূপা। সে প্রসঙ্গ তুলে রাজীবের মন্তব্য, ‘‘বিজেপি নেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায় রোড শো’র নামে গোলমাল পাকাতে আসছেন। কলকাতার গোপালনগরে আমাদের দলের পতাকা ছিঁড়ে দিয়ে তিনি গোলমাল পাকান। আমাদের পতাকা টাঙানো নিয়ে তাঁর যদি আপত্তি থাকে, তা হলে তাঁর উচিত ছিল নির্বাচন কমিশন বা প্রশাসনকে জানানো। তা না করে তিনি নিজেই পতাকা ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। এ জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা উচিত।’’

তৃণমূল শিবিরের বড় অংশ অবশ্য রাজীব নন, রূপার বিরুদ্ধে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মুখ খোলায় বিস্মিত। তাঁদের মতে, রূপা রাজনীতিতে নবাগত। এই প্রথম প্রচারে নেমেছেন। তাঁর সম্পর্কে আগ বাড়িয়ে মন্তব্য করে মমতার মতো পোড় খাওয়া নেত্রী কি রূপাকে একটু বেশিই গুরুত্ব দিয়ে ফেললেন না? নিজের অজান্তেই রূপাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীর মর্যাদা দিয়ে বসলেন না? বিস্ময় বিজেপি শিবিরেও। রাজ্যে বিজেপির একমাত্র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ‘‘বাংলা থেকে ৩৪ বছরের বাম শাসনকে উৎখাত করেছেন যে নেত্রী, তাঁকে এই নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে হচ্ছে?!’’

গোপালনগরের ঘটনা এবং তার পরে তৃণমূলের প্রতিক্রিয়ায় রূপা যে ভাবে বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছেন তা নিয়ে শাসকদলের অন্দরের অস্বস্তি ধরা পড়েছে তৃণমূল মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়। গোপালনগরের ঘটনায় পাল্টা মামলা দায়ের করা নিয়ে কোনও বিশ্লেষণে অনীহা প্রকাশ করে তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভাল অভিনেত্রী হলেই বড় নেত্রী হন না। অনেক লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে নেতা হতে হয়। নেত্রী রূপাকে নিয়ে আমার কথা বলার সময় নেই।’’ কিন্তু তাঁর দলের সর্বোচ্চ নেত্রীই তো রূপার গ্রেফতারের দাবি তুলেছেন! পার্থবাবুর দাবি, ‘‘রূপা কি না, জানি না! সে তো অনেকেই আমাদের দলের পতাকা ছিঁড়ছেন। হয়তো সে ব্যাপারেই কারও কথা মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন।’’

পার্থবাবু যেমন অস্বস্তি আড়াল করতে রূপাকে গুরুত্ব দিতে চাননি, তেমনি পাল্টা কৌশল হিসেবে গ্রেফতারের দাবিকে পাত্তা দিতে চাননি রূপাও। এ দিন উলুবেড়িয়ায় যাওয়ার পথে তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে মমতার অভিযোগ খুঁটিয়ে শোনেন। তার পর বিষয়টি গায়ে না মেখে বলেন, ‘‘আমি তো কোনও ফ্ল্যাগ ছিঁড়িনি বা পা দিয়ে মাড়াইনি। সুতরাং, মুখ্যমন্ত্রী বোধহয় অন্য কারওর কথা বলেছেন।’’ টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারেও মমতার অভিযোগ-প্রসঙ্গে রূপা বলেছেন, ‘‘ওঁরা রাজনীতির ক্ষেত্রে বয়োজ্যেষ্ঠ। তবে আমি আইন-শৃঙ্খলা বুঝি। রাজ্যের আইন আমাকে যে শাস্তি দেবে, তা আমি বুঝে নেব।’’

কলকাতা পুলিশ সূত্র বলছে, রূপা তৃণমূলের পতাকা ছিঁড়েছেন বা পা দিয়ে মাড়িয়েছেন এমন খবর তাদের কাছে নেই। তাদের খবর হল, কিছু লোক রূপার উদ্দেশে কটূক্তি করে। রূপাও তার জবাব দেন ও তার পরে মঞ্চ থেকে তৃণমূলের পতাকা খোলা হয়। রূপা নিজেও মঙ্গলবারের ঘটনার পরে বলেছিলেন, ‘‘মঞ্চে উঠে মাইক নিয়ে আমি বলি, সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত সভা করার জন্য পুলিশ আমাদের অনুমতি দিয়েছে। তা হলে এখন এই (তৃণমূলের) পতাকাগুলোর দরকার নেই। এই বলে আমি পতাকাগুলো খুলতে শুরু করি। সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূলের লোকেরা আমার উপর চড়াও হয়।’’

পরে আলিপুর থানায় এ নিয়ে অভিযোগ জানান রূপা। বুধবার আবার বিপ্লব মিত্র নামে জনৈক তৃণমূল কর্মীর তরফে রূপা এবং আরও কয়েক জনের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার পাল্টা অভিযোগ দায়ের করা হয়। গোপালনগরের ঘটনার প্রতিবাদকে সামনে রেখে বুধবারই দক্ষিণ কলকাতায় রোড শো করে বিজেপি। রূপা তার পুরোভাগে ছিলেন। তাঁর শরীরী ভাষা ছিল নজর কাড়ার মতো। তার পরেই এ দিন মমতা যে ভাবে তাঁর গ্রেফতারির জন্য সওয়াল করলেন, তাতেই প্রশ্ন উঠছে যে— মমতা কি তবে রাজনীতির ময়দানে রূপাকে সমীহ করতে শুরু করলেন? নইলে রূপাকে এত গুরুত্ব দেবেন কেন তিনি?

গোপালনগরের ঘটনাকে আগেই নাটক বলে দাবি করেছিল শাসক দল। সে কথা প্রচারের দায়িত্ব এ দিন নিজের কাঁধে নিয়ে নেন মমতা। তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা ফ্ল্যাগ ছেঁড়া নিয়ে নাটক করে দেখান, যাঁরা ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়াকে তৃণমূলের বলে চালান, তাঁদের বলব একটু পজিটিভ (ইতিবাচক) হোন।’’

কিন্তু ঘটনা হল, রূপার উপরে হামলা এবং তাঁরই বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা দায়ের করানোর ঘটনায় রাজ্যপাল থেকে শুরু করে অনেকেই আলোড়িত। এ দিন নির্বাচন কমিশনার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলে রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী রূপার ঘটনা নিয়ে জানতে চান। নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতের বহু বিশিষ্ট মুখও রূপার ঘটনায় উদ্বিগ্ন। তবে তাঁরা কেউই বিস্মিত নন। যেমন সুমন মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এমন প্রতিহিংসার রাজনীতি তো মমতা আগেও করেছেন। ভোট সামনে বলে ফের দাঁত-নখ বেরিয়ে পড়েছে।’’ ভোটে লড়তে গিয়ে শাসক দলের ‘মিথ্যা’ অভিযোগের মুখে পড়েছিলেন বর্তমানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। সেই উদাহরণ অনেকেরই মনে পড়ে গিয়েছে। রূপার সঙ্গে যা ঘটেছে, তা ‘অনভিপ্রেত’ বলে বুধবার সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করেন তৃণমূল সাংসদ দেব। এ দিন অবশ্য তিনি মমতার মিছিলে হেঁটেছেন। হেঁটেছেন সায়ন্তিকা, শ্রাবন্তী, অনীক ধর, রণিতার মতো অনেকেই। এ প্রসঙ্গে নাট্যব্যক্তিত্ব কৌশিক সেনের বক্তব্য, ‘‘আমি ওঁদের বলব, ওঁরা আবারও মমতার মিছিলে হাঁটুন, আরও পুরস্কার পান, কিন্তু রাতে ফিরে ভাবুন, রূপার সঙ্গে যা ঘটেছে, তা অন্য যে কারও সঙ্গেও ঘটতে পারে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE