Advertisement
E-Paper

গলিতে আর ভাসে না ম্যান্ডোলিনের সুর

পরিবর্তনের এই যুগেও কিছু জিনিস অপরিবর্তিত থেকে যায়। ঠিক যেমন আমাদের পাড়া ফরডাইস লেন। সময় এখানে যেন থেমে গিয়েছে। আজও পাড়া মানে সেই জায়গা, যেখানে এলে ক্লান্তি, অবসাদ, বিষণ্ণতা ভুলে মেতে উঠি অনাবিল আনন্দে।

তুলসী দত্ত

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৭ ০১:২০
দিন-যাপন: ফরডাইস লেনের এটাই চেনা দৃশ্য। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

দিন-যাপন: ফরডাইস লেনের এটাই চেনা দৃশ্য। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

পরিবর্তনের এই যুগেও কিছু জিনিস অপরিবর্তিত থেকে যায়। ঠিক যেমন আমাদের পাড়া ফরডাইস লেন। সময় এখানে যেন থেমে গিয়েছে। আজও পাড়া মানে সেই জায়গা, যেখানে এলে ক্লান্তি, অবসাদ, বিষণ্ণতা ভুলে মেতে উঠি অনাবিল আনন্দে।

বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে শুরু হয়ে পাকদণ্ডীর মতো ঘুরে পাড়ার রাস্তাটা এক দিকে ডিক্সন লেনে, অন্য দিকে, সারপেনটাইন লেনে গিয়ে মিশেছে। প্রবীণদের মুখে শুনেছি, কাছেই স্কট লেনে ছিল বড়সড় ঘোড়ার আস্তাবল। তার মালিক ছিলেন ফরডাইস সাহেব। তাই পাড়ার নাম ফরডাইস লেন। এটি ছিল অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পাড়া। পরবর্তী কালে অন্য ধর্মের মানুষ থাকতে শুরু করেন।

এ পাড়ায় এখন মিশ্র সংস্কৃতি। বাঙালিয়ানা অটুট। বেশির ভাগ পুরনো বাড়ি। তৈরি হচ্ছে কিছু বহুতল। প্রতিবেশীরা বহু দিনের। সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে পূর্ণমাত্রায়। বিপদে সকলকে পাশে পাওয়া যায়।

পাড়ার সকালটা অন্য রকম এখানে। কাছেই কোলে মার্কেট আর বৈঠকখানা বাজার থাকায় রাত থেকেই শুরু হয়ে যায় মালবাহী ভ্যান ও ঠেলাগাড়ির যাতায়াত। তাই রাতেও জমজমাট থাকে পাড়াটা। তবে সকালে এ পাড়া দিয়ে হাঁটাচলা বেশ কষ্টকর।

পরিবর্তনের মাঝেও অটুট পাড়ার আড্ডাটা। এখনও শতাব্দীপ্রাচীন তেলেভাজার দোকানে আড্ডায় বসি। সন্ধ্যায় বিভিন্ন বয়সের মানুষের আড্ডা বসে। রাতে বসে অফিস ফেরত মাঝ-বয়সিদের আড্ডা। এই আড্ডাই পাড়ার যোগসূত্রটা ধরে রেখেছে।

উন্নত নাগরিক পরিষেবা মিলছে এখানেও। বসেছে জোরালো আলো। পাড়াতেই রয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব ভলান্টারি ব্লাড ডোনার্স। হাসপাতালে যখন রক্তের প্রয়োজন হয়, তার চাহিদা মেটায় এই সংস্থা।

খেলাধুলোর হাতেখড়ি পাড়ার ভাঙা মাঠে। সেটা আর নেই। বদলেছে খেলাধুলোর ছবি। পাড়ায় পার্কিং সমস্যা নেই। তবে সকালে স্কুলের গাড়ি ঢুকলে যানজট হয়। এ পাড়ায় রয়েছে ইস্ট লাইব্রেরি। মনে পড়ে লাইব্রেরিয়ান অনিলবাবুর কথা। নতুন বই এলে ছেলেদের বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসতেন। সেই আন্তরিকতা কোথায়? সেই লাইব্রেরি এখন মৃতপ্রায়।

বর্তমানের মাঝেই হাতছানি দেয় এ পাড়ার অতীত ছবিটা। এক সময়ে এ পাড়াতেই ছিল ছ’টা মেস বাড়ি। থাকতেন চাকুরিজীবীরা। এক-একটিতে এক-এক জেলার মানুষ বাস করতেন। তাঁদের সঙ্গে আমাদের পাড়ার সকলে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। প্রতি রবিবার হতো ঘরোয়া পিকনিক। তাতে আমাদের সাদর আমন্ত্রণ থাকত। বাড়িতে কোনও কারণে জল না থাকলে মেসবাড়ির ঠান্ডা জলে মনের সুখে স্নানপর্ব সারতাম। আর ফেরার আগে উৎকলবাসী বামুনঠাকুরের কাছে মিলত গরম গরম মাছভাজা।

সন্ধ্যার পরে পাড়ায় রাস্তায় ঘোরা ফেরা করলে পাড়ার দাদারা চড়-থাপ্পড়ও মারতেন। তখন সন্ধ্যা নামলেই সুর করে পড়া নামতার সুর। হারমোনিয়াম বাজিয়ে সরগমের অনুশীলন। রাতের দিকে আসত বেলফুলওয়ালা। এখনও আসে কুলফিমালাইওয়ালা। তবে হারিয়ে গিয়েছে অনেক ফেরিওয়ালার ডাক।

এ পাড়ায় কিছু মানুষ ছিলেন যাঁরা যে কোনও সমস্যায় মানুষের পাশে দাঁড়াতেন। আজও আছেন রতন রাউথ। যাঁকে এক ডাকে পাশে পাওয়া যায়। মনে পড়ে জনদার কথা। ভাল ম্যান্ডোলিন বাজাতেন। গভীর রাতে তার সুর পাড়ার অলি গলি বেয়ে ছড়িয়ে পড়ত। পাড়াটা তখন কেমন একটা মায়াময় হয়ে উঠত।

লেখক প্রাক্তন সাংবাদিক

Fordyce lane old melodies Tulsi Dutta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy