স্কুল ছুটির দিনেও মিড ডে মিল!
দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর ২ নম্বর ব্লকের অধীন চকএনায়েতনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের উদয়রামপুর পল্লিশ্রী শিক্ষায়তনের ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের মিড ডে মিলের তালিকা ঘেঁটে মিলেছে এমনই তথ্য।
ওই বছর ৩ থেকে ৬ জানুয়ারি স্কুল ছুটি ছিল। অথচ ৩, ৪, ৪ এবং ৬ জানুয়ারির মিড ডে মিলের হিসেব দেওয়া হয়েছে সেই তালিকায়। ৪ জানুয়ারি, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মোট পড়ুয়া দেখানো হচ্ছে ৩৬০ জন। ফের ওই তারিখেরই উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে ৩৮৭ জন। ১৪ জানুয়ারি ফতেয়া দোয়াজ দহম এবং পৌষ সংক্রান্তিতে ছুটি ছিল। অথচ ওই দিন ৭৯৭ জন মিড ডে মিল পায়। এ বছর মে-তে সোমনাথ ঘোষ নামে এক ব্যক্তি জানুয়ারি ২০১৪-র মিড ডে মিলের হিসেবের কপি চেয়ে আরটিআই করলে মেলে এই তথ্য।
বিতর্কের শুরু ২০১৪ সালে। ব্লক স্তরে বিভিন্ন সময়ে আলোচনার মাধ্যমে উঠে আসা কিছু তথ্যের উল্লেখ করে বিষ্ণুপুর-২ নম্বর ব্লকের বিডিও শমিতা রায় অতিরিক্ত জেলাশাসককে (ভূমি সংস্কার, দক্ষিণ ২৪ পরগনা) এই বছর মে-তে একটি চিঠি লেখেন। তাতে লেখা, শুধু জানুয়ারির বিলেই মিড ডে মিল বাবদ ২৬,৪৫৫ টাকা বেশি দেওয়া হয়েছে। গোষ্ঠী টাকা তুলেও নিয়েছে। এই ভাবে জানুয়ারি থেকে অগস্ট ২০১৪ পর্যন্ত অতিরিক্ত ১,০২,৪১৫ টাকা গোষ্ঠীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। রয়েছে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যেমন—
১) মিড ডে মিলের পরিচালনা করছিল ‘প্রচেষ্টা’ নামে একটি স্বনির্ভর গোষ্ঠী। গোষ্ঠীর তৎকালীন সভাপতি দীপ্তি সাউ ২০১৪-র মার্চে ইস্তফা দেন। তখন দলেরই আরও তিন জন পদত্যাগ করলে সদস্য আট হয়। স্বর্ণ জয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনার (এস জি এস ওয়াই)-এর নিয়ম, ন্যূনতম দশ জন সদস্য থাকা উচিত। সভাপতির নাম বদলও এস জি এস ওয়াই-এর নিয়ম মেনে হয়নি। জেলা গ্রামোন্নয়ন শাখায় ওই গোষ্ঠীর নথিভুক্ত নামের সঙ্গেও মিল নেই কয়েক জনের নাম। চিঠিতে রয়েছে, অগস্ট ২০১৪ থেকে মিড ডে মিল চালাচ্ছেন স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক।
২) ৭ই জানুয়ারি ২০১৫-র সভায় মিড ডে মিল অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হয়। সব খতিয়ে দেখে এ বছরের ১৯ মে কমিটি রিপোর্ট জমা দেয়। সেই রিপোর্টে ২০১৪-র জানুয়ারি থেকে অগস্ট পর্যন্ত অতিরিক্ত পড়ুয়া দেখানো হয়েছে। তা যথাক্রমে ২২৫৭ জন, ৮৬১ জন, ৪১৩১ জন, ৫১৩ জন, ৪২৯ জন, ২৭০১ জন, ৪৩০০ জন।
চিঠিতে ওই গোষ্ঠীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যে অতিরিক্ত সরকারি অর্থ জমা দেওয়া হয়েছে সেই বিষয়েও অতিরিক্ত জেলাশাসকের কাছে নির্দেশ চাওয়া হয়েছিল। উত্তর আসেনি।
দীপ্তি সাউ বলেন, ‘‘২০১৩-র ডিসেম্বরে প্রধানশিক্ষক মিটিং ডেকে আমাকে সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেন। বলেন, দলের মেয়েরা আমায় চায় না। পঞ্চায়েত প্রধান জানান, এ ভাবে সরানো অনৈতিক। বিডিও কার্যালয়ে মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হয় আমিই সভাপতি থাকব। কিন্তু দল এবং প্রধান শিক্ষক আমাকে না জানিয়ে সব সিদ্ধান্ত নিতে থাকায় ২০১৪-র মার্চেই ইস্তফা দিই।’’
দীপ্তিদেবীর পরবর্তী গোষ্ঠী-সভাপতি সুমিত্রা সিংহ বলছেন, ‘‘তিন চার দিন বাদে বাদে কুকিং খাতায় তুলতে গিয়ে সম্ভবত কিছু ভুল হয়। কুকিং খাতা হেড স্যারের কাছে দিয়ে আসতাম। তিনিই বিল করতেন।’’
স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মিড ডে মিলের হিসেবে হস্তাক্ষর রয়েছে স্কুলের প্রধানশিক্ষক উত্তম মণ্ডলের। তিনি বলছেন, ‘‘মিলিয়ে দেখতে আমার হয়তো ভুল হয়েছে।’’ গোষ্ঠী ভেঙে যাওয়ার পরেও তিনি মিড ডে মিল পরিচালনা করছেন কী ভাবে? কোনও উত্তর মেলেনি উত্তমবাবুর থেকে।
স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি ও পঞ্চায়েতের অভিযোগ, সব জেনেশুনেও স্কুলের প্রধানশিক্ষক এবং ওই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।
বিডিও শমিতা রায়ের উদ্যোগে তৈরি মিড ডে মিল মনিটরিং কমিটি এবং স্কুল ম্যানেজিং কমিটিতে রয়েছেন চকএনায়েত নগর গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য গোলাম হায়দর শেখ। তিনি বলেন, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরেই দুর্নীতি চলছে। বিডিও কে বহু বার বলা হয়েছে। কিন্তু জেলাশাসককে চিঠি লেখা ছাড়া আর কোনও ব্যবস্থাই নেননি।’’
বিডিও শমিতাদেবী বলছেন, ‘‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। নির্দেশ মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ ছ’মাসেও কেন কিছু হল না? তিনি বলেন, ‘‘মিটিং-এ আছি। যা করার আমরা জেনে বুঝে করব।’’ সূত্রের খবর, স্কুলের নামে মিড ডে মিল অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। এ মাসের ১১ তারিখে পঞ্চায়েত প্রধান, প্রধানশিক্ষক-সহ কয়েক জনের উপস্থিতিতে বিডিও কার্যালয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ২০১৪-র অগস্ট পরবর্তী মিড ডে মিলের হিসাব জমা করলে তা মিলিয়ে ওই অ্যাকাউন্টে জমা হবে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমিরাজস্ব) আর্শাদ হাসান ওয়ারসি বলছেন, ‘‘সম্প্রতি দায়িত্ব নিয়েছি। আমি আসার পরে কোনও চিঠি পাইনি। খোঁজ নিচ্ছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy