বাতিল রেফ্রিজারেটরে বই। পাটুলিতে। নিজস্ব চিত্র।
‘ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির পাঁচ বোন থাকে কালনায়, শাড়িগুলো তারা উনুনে বিছায়, হাঁড়িগুলো রাখে আলনায়।’ রবিঠাকুরের কবিতার এই লাইনগুলোই যেন ভেসে উঠছে দক্ষিণ কলকাতার পাটুলির বৈষ্ণবঘাটা এলাকার ছোট্ট একটি মুদিখানার সামনে।
ইএম বাইপাসের পাটুলি মোড় থেকে বাঁ দিকে পাটুলি দমকল কেন্দ্রের সামনে দিয়ে কিছুটা এগোলেই ডান দিকে চোখে পড়বে ছোট্ট সেই মুদির দোকান। দোকানের বাইরে রাখা একটি বাতিল ফ্রিজ, যার ভিতরে সাজানো বিভিন্ন ধরনের বই। পাশে আরও একটি বই রাখার জায়গা করা আছে। সেখানেও রয়েছে ইংরেজি-বাংলা হরেক রকম বই। বিভিন্ন বয়সের পাঠকেরা সেখানে আসছেন। পছন্দ মতো বই নিয়ে নিজের নাম, ফোন নম্বর নথিভুক্ত করিয়েই চলে যাচ্ছেন। অনেকে আবার দোকানের সামনে রাখা চেয়ারে বসেই বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন।
পাটুলির এই স্ট্রিট লাইব্রেরির শুরুটা হয়েছিল গত ২১ ফেব্রুয়ারি। কলকাতার একটি নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র, বছর চোদ্দোর কিংশুক হালদারের ইচ্ছেতেই তার বাবা-মা কালীপদ হালদার ও কুমকুম হালদার ওই পথ গ্রন্থাগারের সূচনা করেন। তাঁরাও ওই এলাকারই বাসিন্দা। মূলত সাধারণ মানুষের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ বাড়াতেই এমন ভাবনা। যে কেউ চাইলেই নিখরচায় ওই গ্রন্থাগার থেকে বই নিয়ে পড়ে আবার ফেরত দিয়ে আসতে পারেন। শুধুমাত্র নাম আর ফোন নম্বর নথিভুক্ত করালেই চলবে। কেউ চাইলে আবার নিজের বাড়ির বই সকলের পড়ার জন্য রেখেও আসতে পারেন। কুমকুম বলেন, ‘‘ছেলে কিংশুকই প্রথম জানায় আশপাশের বন্ধুদের মোবাইলে আসক্তির কথা। তাই সকলের বইয়ের প্রতি আগ্রহ বাড়াতেই কিছু একটা করার কথা সে আমাদের বলে। আর সেই ভাবনা থেকেই এই স্ট্রিট লাইব্রেরির সূচনা।’’
কুমকুম জানান, প্রথমে শ’পাঁচেক বই নিয়ে তাঁদের গ্রন্থাগার চালু হয়। বাড়িতে তেমন জায়গা না থাকায় ফ্ল্যাটের সামনে থাকা ওই মুদিখানার মালিক তারাপদ কাহারকে অনুরোধ করা হয় দোকানের সামনে একটু জায়গার দেওয়ার জন্য। তিনি রাজি হয়ে যান।
সেই শুরু। প্রথমে বাড়ির বাতিল ফ্রিজকেই বই রাখার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরে ওই ফ্রিজের পাশে আরও একটি বই রাখার ছোট জায়গা করা হয়। সেখানেও রাখা হয় সারি সারি বই। সোশ্যাল মিডিয়ায় জানানো হয় এই উদ্যোগের কথা। বিভিন্ন জায়গা থেকে বই দান করতে চেয়ে অনেকেই ফোন করতে থাকেন।
ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে গ্রাহকের সংখ্যাও। শনি ও রবিবারই বেশি ভিড় হয় বলে জানালেন কুমকুম। তিনি বলেন, ‘‘এখন প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোন আসে। কয়েক দিন আগে তো কাঁচরাপাড়া থেকে এক শিক্ষিকা নিজেই গাড়ি নিয়ে
এসে প্রায় দেড়শো বই দিয়ে গিয়েছেন। যাদবপুরের এক বৃদ্ধাও তাঁর বাড়ির কয়েকশো দুষ্প্রাপ্য বই আমাদের এখানে ‘ভরসা করে’ দিয়েছেন।’’ ইসরো-র এক কর্তাও এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে ফোন করেছিলেন বলে জানান কুমকুম। সেই ভদ্রলোক ওই গ্রন্থাগারে বই নিতে আসা পড়ুয়াদের অনলাইনে বিজ্ঞানের ক্লাস করাতে চান বলেও জানিয়েছেন।
কলকাতার একটি স্কুলের শিক্ষক কালীপদবাবু নিজেও বিভিন্ন জায়গা থেকে বই সংগ্রহ করে আনছেন। এখন ওই গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। কুমকুম বললেন, ‘‘এখন এত বই হয়ে গিয়েছে যে, দোকানে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাড়িতেই কিছু রাখতে হচ্ছে। আপাতত একটা ভাল জায়গার ব্যবস্থা করতে না পারলে সব বই একসঙ্গে রাখা সম্ভব হবে না।’’
কিন্তু বই নিয়ে কেউ যদি ফেরত না দেন? এই প্রশ্নের উত্তরে কুমকুম বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত বই নিয়ে গিয়ে ফেরত দেননি, এমন ঘটনা ঘটেনি। তবে যদি তেমন ঘটেও, ক্ষতি কী! বই আর যা-ই হোক, কাউকে খারাপ তৈরি করবে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy