Advertisement
০৪ মে ২০২৪

মায়ের উঠোনে জড়ো হয়ে শিহরিত মিনি বিশ্ব

ভ্যাটিকানের গির্জার জমকালো প্রাসাদ না-থাকতে পারে। ছায়াঘেরা এই চিলতে উঠোনটুকুই বা কম কীসে? রবি-দুপুরে এন্টালির জোড়া গির্জার কাছে মাদার হাউস-এর প্রাঙ্গণ যেন এক টুকরো মিনি পৃথিবী! সমবেত টেরিজা-ভক্তদের সামনে তা যেন বিছিয়ে দিল বিশ্বমায়ের আঁচল। দু’দশক আগে কোনও-কোনও দিন ওই উঠোনেই নেমে আসত ঝুঁকে পড়া বৃদ্ধার ছোট্টখাট্টো অবয়ব।

কলকাতার মাদার হাউসে। রবিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

কলকাতার মাদার হাউসে। রবিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:২৩
Share: Save:

ভ্যাটিকানের গির্জার জমকালো প্রাসাদ না-থাকতে পারে। ছায়াঘেরা এই চিলতে উঠোনটুকুই বা কম কীসে?

রবি-দুপুরে এন্টালির জোড়া গির্জার কাছে মাদার হাউস-এর প্রাঙ্গণ যেন এক টুকরো মিনি পৃথিবী! সমবেত টেরিজা-ভক্তদের সামনে তা যেন বিছিয়ে দিল বিশ্বমায়ের আঁচল। দু’দশক আগে কোনও-কোনও দিন ওই উঠোনেই নেমে আসত ঝুঁকে পড়া বৃদ্ধার ছোট্টখাট্টো অবয়ব। কিংবা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নীলপাড়-সাদা শাড়ির ফাঁকে শীর্ণ হাতখানা অনুরাগীদের আশ্বাস দিত।

আর সেই নারীর সন্ত-স্বীকৃতির দিনে সেই উঠোনে দাঁড়িয়ে রোমাঞ্চিত হল সারা দুনিয়া থেকে আসা রং-বেরঙের মানুষ।

সামনে ঢাউস পর্দায় ভ্যাটিকানের সন্তায়ন অনুষ্ঠান। কিন্তু মাদারের ‘ছেলেমেয়েদের’ কাছে কম মহিমময় নয় সিঁড়ির মাথায় মায়ের ঘর, সাবেক খড়খড়িওয়ালা সেকেলে জানলাগুলো। কিংবা উঠোনের ও-পাশের বড় হলঘরটি, যেখানে কলকাতার ‘মাদার’ তথা ‘সেন্ট টেরিজা অব ক্যালকাটা’ বাঁধানো সমাধিতে শায়িত।

এ হেন পটভূমিতে স্পেন, জাপান, ক্যামেরুন বা দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা জনতার স্মার্টফোন, উঁচিয়ে ধরা সেল্‌ফি-স্টিক পটাপট নিজস্বী ফ্রেম-বন্দি করতে থাকল। মেক্সিকো সিটি থেকে আসা বাইশ জনের দলের নেতৃত্বে সৌম্য চেহারার পাদ্রি এঞ্জেলো। ছবি তুলতে তুলতে বললেন, ‘‘ভ্যাটিকানে বহু বার গিয়েছি। কলকাতায় এই প্রথম। আমরা তীর্থ করতে এসেছি।’’ স্পেনের একটি জনপ্রিয় ক্যাথলিক কাগজের সাংবাদিক পাবলো বিষম ব্যস্ত। তিনি চিনে ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ কভার করতে তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হয়েছে।

ভ্যাটিকানের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে মিতভাষী সন্ন্যাসিনীদের গাম্ভীর্যের মোড়কও কিছু ক্ষণের জন্য উধাও। ভিতর থেকে ঘোষণা হল, ‘আমাদের মা টেরিজা এখন সেন্ট! আনন্দ করুন! রিজয়েস..!’ টেরিজার নামে জয়ধ্বনির ফাঁকে উঠোন ঘেরা বারান্দা জুড়ে সিস্টারদের জমায়েত রঙিন কাগজ ফুলের বৃষ্টিতে ঢেকে ফেলল দেশ-বিদেশের ভক্তকূলকে ‘মাদার’কে ঘিরে বিশ্বজনীন আসরে খাস ভ্যাটিকানে বাংলায় প্রার্থনা করেছেন এ শহরের সন্ন্যাসিনী সিস্টার অমলা। মাদারের কাছে তাঁর আর্জি— ন্যায় ও শান্তিতে প্রতিটি মুহূর্ত মানুষের জীবন সুরক্ষিত করুন, শক্তি ও মর্যাদা দান করুন! কলকাতায় ‘মায়ের উঠোনে’র জয়ধ্বনিতে আবার ইংরেজি, ফরাসি, স্প্যানিশ একাকার। স্পেন থেকে আসা ভক্তেরা দলে বেশ ভারী। তাঁদের সৌজন্যে বারবার শোনা গেল ‘সান্তা তেরিসা দ্যু কালকুতা’র নাম। পাশে মাদারের সমাধিকক্ষ জুড়ে ভক্তদের অর্পিত ফুল আর তিরতিরে মোমশিখা। টেরিজার ১০৬ বছরের জীবনের স্মরণে সরকারি তরফে ১০৬ গোলাপের শুভেচ্ছাও তত ক্ষণে হাজির।

এ দিন ভারতীয় সময় বেলা দু’টো নাগাদ ভ্যাটিকানের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। তার ঢের আগেই মাদার হাউসে দু-দু’টো জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনে ঠাসা জনতা। বাইরে পুর-উদ্যোগে বাঁধা মঞ্চে নেতা-মন্ত্রীদের সামনে মাতৃমহিমার ব্যাখ্যায় ব্যস্ত মিশনারিজ অব চ্যারিটি-র সিস্টার লাইজা, কলকাতার বিশপের প্রতিনিধি ফাদার মলয় ডি’কস্টারা। রামকৃষ্ণ মিশনের আলমবাজার মঠের স্বামী সারদাত্মানন্দ বললেন মাদারের ‘শিবজ্ঞানে জীব সেবা’র কথা। ভিতরে নীলপাড় সাদা শাড়ির সিস্টারেরা তখন দেশ-বিদেশের ভক্তদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। ‘বড় আশা করে এসেছি’র সুর ভেসে আসার সময়ে পর্দায় দেখা গেল, ভ্যাটিকানে গান গাইছেন উষা উত্থুপ।

কলকাতার ভ্যাপসা গুমোটে গোড়ায় খানিকটা ধস্ত লাগছিল ভিড়টাকে। মেক্সিকোর ক্লাউদিয়া ঘন ঘন গ্লুকোজের জলে চুমুক দিচ্ছেন। আলুভাজার প্যাকেট হাতে কানাডার কৃষ্ণাঙ্গ যুবা অলিভিয়েরের মুখ চলছে। এক মলিনবেশ সাফাইকর্মীকেও বানরুটি হাতে ওই ভিড়ে বসিয়ে দিলেন সিস্টারেরা। সন্তায়নের অনুষ্ঠান শুরুর পরে ভ্যাটিকানের প্রাসাদের গায়ে মাদারের ছবি দেখেই হাততালির ঝড়। তাল মিলিয়ে ঠোঁট নেড়ে প্রার্থনা। এ সবের মাঝে ভ্যাটিকানের ভিড়ে দেশের জাতীয় পতাকা, কলকাতার আর্চবিশপ টমাস ডিসুজা বা মিশনারিজ অব চ্যারিটি-র সিস্টার প্রেমাকে দেখে উচ্ছ্বাসও বাদ গেল না।

টেরিজার সমাধিকক্ষে বসে আস্তে আস্তে কথা বলছিলেন এন্টালি পাড়ার মেয়ে শ্যামলী রোজারিও। ‘‘ছোটবেলায় মাদারকে কত দেখেছি! এমন দিনে ওঁর বাড়িতে থাকতে পেরে অদ্ভুত ভাল লাগছে।’’ কোকরাঝাড়ের মেয়ে দোবরি মাইনা বা কোন্নগরের আইনজীবী অতনু জর্জ মুখোপাধ্যায়ও আপ্লুত। রিপন স্ট্রিটের জুলি গোমসের পরিকল্পনা ছিল, এই দিনটা ভ্যাটিকানে কাটাবেন। পড়শি-বন্ধু ফিলোমেনা ওখানে চলে গিয়েছেন। কিন্তু ভিসা-ঝঞ্ঝাটে জুলির যাওয়া হয়নি। তবে মাদার হাউসের আবহ তাঁর সব আফসোস ভুলিয়ে দিয়েছে।

বিকেলের মুখে ভ্যাটিকান থেকে পোপের প্রতিনিধিরা ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’-র সকলকে ধন্যবাদ জানাতে ঢুকলেন মাদার হাউসে। তাঁদের হাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে স্বাগত জানানো হল। টেরিজার দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠ তথা মাদার হাউসের অন্যতম মুখপাত্র সুনীতা কুমারের কাছে মাদার অবশ্য সবার আগে মা। অনেকের কাছে টেরিজার সন্ত-স্বীকৃতি নেহাতই আনুষ্ঠানিকতা। যদিও দেশ-বিদেশের খ্রিস্টীয় পরিমণ্ডলে সন্ত-অভিধার গুরুত্ব কেউ অস্বীকার করছেন না।

নীলপাড় সাদা শাড়ির ছোট্টখাট্টো নারীর সৌজন্যে কলকাতা সেই আন্তর্জাতিক মানচিত্রে ঢুকে পড়ল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Canonisation Mother Teresa Mother House
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE