অরক্ষিত: কোনও রকম সুরক্ষা ছাড়াই ম্যানহোলে নেমে কাজ করছেন পুরসভার এক সাফাইকর্মী। খিদিরপুরে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
সারা শরীর ঢাকা থাকবে বিশেষ ধরনের প্লাস্টিক এপ্রনে। পায়ে থাকবে গামবুট, হাতে দস্তানা। কোমরে বাঁধা থাকবে বিশেষ দড়ি। মাথায় হেলমেট। প্রয়োজন বিশেষে পরতে হবে মুখোশও।
এ সব নিয়ম রয়েছে। তবে সে সব বন্দি হয়ে আছে শুধু খাতায়-কলমেই! বাস্তবে অবশ্য এর কিছুই থাকে না। মাথায় একটা গামছা জড়িয়ে আর হাতে একটা বালতি নিয়েই ম্যানহোলে নেমে পড়েন পুরকর্মীরা। তার পরে ওই বালতি দিয়েই চলে ভিতরের পাঁক সাফাই। কোমরে বাঁধার দড়িটুকু পর্যন্ত থাকে না। গামবুট, দস্তানা বা মুখোশ তো অনেক দূরের বস্তু!
নিয়ম অনুযায়ী কোনও ম্যানহোলে নামার আগে জেনে নিতে হয়, ভিতরে বিষাক্ত গ্যাস জমে আছে কি না। তার জন্য যে যন্ত্র পাওয়া যায়, তা-ও অবশ্য থাকে না ওই সাফাইকর্মীদের সঙ্গে। যন্ত্রের থেকেও ওঁদের ভরসা বেশি আরশোলাদের উপরে। কারণ, কোনও জায়গায় মিথেন গ্যাস জমে থাকলে সেখানে কোনও প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারে না। ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে পুরকর্মীরা যদি দেখেন, ভিতরে আরশোলা ঘুরছে, তবেই নিশ্চিন্ত হয়ে ভিতরে নামেন তাঁরা।
মানুষ নামিয়ে ম্যানহোল পরিষ্কার করা আইনত নিষিদ্ধ। ক্ষেত্র বিশেষে তা করা হলেও তার জন্য যে সব সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার, তার প্রায় কিছুই দেখা
যায় না এ শহরে। ম্যানহোল পরিষ্কারের জন্য এখনও নির্দিষ্ট পদে কর্মীরা রয়েছেন কলকাতা পুরসভায়! ওই পদের নাম ‘সুয়্যার ক্লেনজিং মজদুর’, সংক্ষিপ্ত আকারে যাঁরা এসসি মজদুর নামেই পরিচিত। ব্রিটিশ আমলে তৈরি ওই পদে এখনও প্রায় ২০০ জন কর্মী রয়েছেন! সেই আমলের ইটের তৈরি নিকাশি নালার পাশাপাশি নতুন নিকাশি লাইনও বসানো হয়েছে শহরে। ‘কলকাতা এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্রুভমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম’-এর (কেইআইআইপি) অধীনে যেখানে শহরের নিকাশির খোলনলচে বদলের কাজ চলছে, সেখানে মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিতে মানুষ দিয়ে কেন ম্যানহোল পরিষ্কার করানো হচ্ছে, স্বাভাবিক ভাবেই তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মানুষ নামিয়ে ম্যানহোল সাফাইয়ের বিষয়টি অমানবিক তো বটেই, এর মধ্যে পরিকল্পনারও বিস্তর অভাব রয়েছে। এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ তথা পুরসভার নগর পরিকল্পনা দফতরের প্রাক্তন ডিজি দীপঙ্কর সিংহ বলেন, ‘‘যন্ত্রের উপরে এখনও আমরা পুরোপুরি নির্ভরশীল হতে পারিনি। তাই এখনও মানুষ দিয়ে ম্যানহোল পরিষ্কার করাতে হচ্ছে! জঞ্জাল সাফাইয়ের কাজও ঠিকঠাক হচ্ছে না। সেটা হলে এত পরিমাণ ময়লা নিকাশি নালায় জমতেই পারত না। তা ছাড়া, এমন অপরিকল্পিত ভাবে চার দিক সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো হচ্ছে যে, তাতে নোংরা আর অন্য কোথাও যেতে পারছে না। সব কিছু নিকাশি নালায় এসেই জমা হচ্ছে।’’ পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলেন, ‘‘যাঁরা ময়লা পরিষ্কার করে আমাদের আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখছেন, তাঁদেরই জীবনের ঝুঁকি রয়েছে মারাত্মক ভাবে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করার জন্য তাঁদের আয়ুও কমে যাচ্ছে। পুরো ব্যবস্থার মধ্যেই একটা পরিকল্পনার অভাব স্পষ্ট।’’
যদিও পুর কর্তৃপক্ষের দাবি, দশ বছর আগের থেকে বর্তমানে অনেকটাই উন্নত হয়েছে পরিস্থিতি। মানুষের উপরে নির্ভরতা ক্রমশ কমানো হচ্ছে। আগে ২০ ফুট নীচের নিকাশি নালাও মানুষ দিয়েই পরিষ্কার করানো হত। হাতে লণ্ঠন নিয়ে ম্যানহোলে নেমে যেতেন পুরকর্মীরা। তার পরে চলত সাফাই অভিযান। কিন্তু বর্তমানে অত গভীরের নিকাশি নালায় মানুষ নামা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই ধারাবাহিক ভাবে ম্যানহোল, নিকাশি নালা পরিষ্কারের নানা যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। সম্প্রতি রাজ্য সরকারের তরফে ৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দও করা হয়েছে ম্যানহোল, নিকাশি নালা পরিষ্কারের যন্ত্র কেনার জন্য।
পুরসভা সূত্রের খবর, ম্যানহোল, নিকাশি নালা সাফাইয়ের জন্য ‘গালিপিট ক্লেনজিং মেশিন’, ‘জেটি কাম সাকশন মেশিন’, ‘পাওয়ার বাকেট মেশিন’, ‘ম্যানহোল ডিসিল্টিং মেশিন’, ‘ব্লো ভ্যাক মেশিন’, ‘ওপেন নালা ডিসিল্টিং মেশিন’-সহ নানা ধরনের যন্ত্র কেনা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আগামী এক বছরের মধ্যে ম্যানহোল, নিকাশি নালা পরিষ্কারের জন্য বরো-ভিত্তিক ২০টি যন্ত্র রাখা হবে। এক পুরকর্তার কথায়, ‘‘শহরের নিকাশি নালার মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪০০ কিলোমিটার। গভীর নিকাশি নালার ক্ষেত্রে মানুষ নামা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাকিটাও আগামী দিনে হয়ে যাবে।’’ নিকাশি দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র পারিষদ তারক সিংহ বলেন, ‘‘অনেক জায়গায় ম্যানহোলে
যন্ত্র প্রবেশ করানো যায় না। শুধুমাত্র সেখানেই পুরকর্মীরা নেমে পরিষ্কার করেন। কিন্তু এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy