Advertisement
২২ মে ২০২৪
কলকাতা মেডিক্যাল

চক্ষুদানে ‘বাধা’ হল হাসপাতালই

মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের অন্তিম ইচ্ছা ছিল, তিনি চলে যাওয়ার পরে যেন তাঁর চোখ দু’টি দান করা হয়। মেডিক্যাল শিক্ষায় ব্যবহারের জন্য যেন দান করা হয় তাঁর দেহটিও।

সুধীরচন্দ্র দাস

সুধীরচন্দ্র দাস

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের অন্তিম ইচ্ছা ছিল, তিনি চলে যাওয়ার পরে যেন তাঁর চোখ দু’টি দান করা হয়। মেডিক্যাল শিক্ষায় ব্যবহারের জন্য যেন দান করা হয় তাঁর দেহটিও। বুধবার গভীর রাতে ওই বৃদ্ধের মৃত্যুর পরে তাঁর ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে প্রস্তুত ছিলেন বাড়ির লোকেরাও। কিন্তু সরকারি মেডিক্যাল কলেজের কিছু চিকিৎসক ও নার্সের ‘অসহযোগিতা’য় শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টা ব্যর্থ হল বলে অভিযোগ উঠেছে। রাতভর টালবাহানায় শেষ পর্যন্ত করা যায়নি দেহদানও। যেখানে মরণোত্তর অঙ্গদান, এমনকী মস্তিষ্কের মৃত্যুর পরে অঙ্গদান উৎসাহিত করতে সরকারি তরফে নানা প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে, সেখানে এমন অভিযোগ ঘোর অস্বস্তিতে ফেলেছে স্বাস্থ্যকর্তাদের। তাঁরা মানছেন, এ নিয়ে এখনও যথেষ্ট সচেতনতা তৈরি না হওয়াতেই এই সমস্যা চলছে।

কেষ্টপুর প্রফুল্লকাননের বাসিন্দা, ক্যানসার রোগী সুধীরচন্দ্র দাস (৮৬) গত কয়েক দিন ধরে ভর্তি ছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। মরণোত্তর চোখ ও দেহদানের অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি। বুধবার রাত সাড়ে ১১টায় তাঁর মৃত্যু হয়। পরিবারের লোকেরা জানিয়েছেন, ওই সময়ে কর্তব্যরত এক চিকিৎসককে জানানো হয় সুধীরবাবুর চোখ দানের ইচ্ছার কথা। তিনিও সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা করতে বলেন। সুধীরবাবুর ছেলে শৈবাল দাস বলেন, ‘‘মেডিক্যাল কলেজের আই ব্যাঙ্কে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পারিনি। এই অবস্থায় সল্টলেকের একটি আই ব্যাঙ্কে যোগাযোগ করি। সেখানকার প্রতিনিধিরা চোখ সংগ্রহ করতে হাসপাতালে পৌঁছেও যান। তাঁরা যখন প্রক্রিয়া শুরু করতে চলেছেন, তখনই ওয়ার্ডের নার্স এবং ডাক্তারেরা বাধা দিতে শুরু করেন।’’

কেন বাধা দিলেন নার্স-ডাক্তারেরা? শৈবালবাবুর বক্তব্য, ‘‘ওঁরা জানতে চান, চোখ দানের অনুমতি কোথায়? আমি বলি, আমার বাবা। আমি চাইছি চোখ দান করা হোক। আর কার অনুমতি দরকার হতে পারে? ওঁরা তখন বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি আনতে হবে। অত রাতে হাসপাতালে কেউ ছিলেন না। পরদিন সকাল ১০টার আগে কর্তৃপক্ষকে পাওয়া যায় না। আমি বার বার অনুরোধ করি, চক্ষুদানের মতো কাজে এ ভাবে বাধা দেবেন না। কিন্তু কেউ সে কথা শুনলেন না, উল্টে আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করলেন।’’

কার্যত সারা রাত এ ভাবে বাগ-বিতণ্ডাতেই কেটে যায়। গোলমাল দেখে ফিরে যান সল্টলেকের ওই আই ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরাও। শেষ পর্যন্ত সুধীরবাবুর চোখ দানের ইচ্ছা অধরাই থেকে যায়। এখানেই শেষ নয়, দীর্ঘক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ায় ক্রমশ শক্ত হয়ে উঠতে থাকে মৃতদেহ। দীর্ঘ রোগভোগ করা ওই শরীরে পচন ধরতে পারে বলেও আশঙ্কা করতে থাকেন পরিজনেরা। আর এই টানাপড়েনে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন সুধীরবাবুর বৃদ্ধা স্ত্রী। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে দেহদানের ইচ্ছাও ত্যাগ করে সকাল ৯টা নাগাদ শ্মশানের দিকে রওনা হন পরিজনেরা।

কিন্তু সুধীরবাবুর শেষ ইচ্ছা যে পূরণ করা গেল না, সেই বিষয়টি প্রতি মুহূর্তে বিঁধছে তার পরিবারের লোকদের। লিখিত ভাবে পুলিশ এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে এ ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করেছেন তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য, যে রাজ্যে মরণোত্তর অঙ্গদানের ব্যাপারে সরকারি তরফে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে বার বার, সেখানে একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে একটি ইচ্ছুক পরিবারকে এ ভাবে ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হবে কেন?

স্বাস্থ্যকর্তারা জানিয়েছেন, পরিবারের লোকেদের সম্মতি থাকলে হাসপাতালকে বিষয়টি জানিয়ে দ্রুতই চোখ দানের ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু রাতবিরেতে যদি এমন কিছু ঘটে, তা হলে শুধুমাত্র কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমতি না পাওয়ার অজুহাতে কাজ আটকে রাখা যায় না। যদি তা হতো, তা হলে রাজ্যে চোখ সংগ্রহের পরিমাণ এক ধাক্কায় অনেকটাই কমে যেত। দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। ওই সময়ে ডিউটিতে থাকা ডাক্তার ও নার্সরা বিষয়টি বুঝতে পারেননি। কিন্তু কারণ যাই হোক, তার ফলাফলটা অত্যন্ত লজ্জাজনক।’’

মেডিক্যালের এক কর্তা বলেন, ‘‘এমন হয়ে থাকলে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তবে অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করে আগে জানা হবে ঠিক কী ঘটেছিল। তার পরে এ নিয়ে কথা বলব।’’

মরণোত্তর চোখ ও দেহদান আন্দোলনের পুরোধা ব্রজ রায়ও ঘটনাটি জেনে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। তাঁর প্রশ্ন, এই ধরনের অভিজ্ঞতার পরে কোন মুখে সাধারণ মানুষকে অঙ্গদানের ব্যাপারে উৎসাহিত করা হবে? তিনি বলেন, ‘‘মানুষকে সচেতন করার শুরুটা হাসপাতাল থেকেই হওয়া উচিত। যাঁদের এই কাজে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আসা উচিত। তাঁরাই যদি এ ভাবে নিরুৎসাহ করেন, তা হলে আমাদের গোটা আন্দোলনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Medical college and Hospital Organ donation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE