দীর্ঘদিন উপোস করতে করতে ২০১৪ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিলেন দেবযানী দে। ২৪ ডিসেম্বর থেকে তিনি ভাইয়ের ডাকে সাড়া দেওয়াও বন্ধ করে দেন। তখন দিদিকে নানা শুকনো খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলেন ভাই পার্থ। লাভ হয়নি। টানা পাঁচ দিন দিদির কোনও সাড়াশব্দ না পাওয়ার পর পার্থ বুঝতে পারেন, দিদি মারা গিয়েছেন।
মঙ্গলবার পাভলভ হাসপাতালে গিয়ে পার্থবাবুর সঙ্গে কথা বলেন তদন্তকারীরা। তখনই পার্থ এই কথা জানান। গত ১১ জুন পাভলভে পাঠানো হয়েছিল পার্থকে। তার পর এ দিনই প্রথম তাঁর সঙ্গে কথা বললেন তদন্তকারীরা। পার্থ এর মধ্যে বারবারই মাদার হাউসে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। মাদার হাউসের সন্ন্যাসিনীদের সামনে কথা বলবেন বলে জানিয়েছিলেন। এ দিন পার্থকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যাওয়ার সময় তাই পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে ছিলেন মাদার হাউসের দুই সন্ন্যাসিনী এবং এক পাদ্রী। ছিলেন পাঁচ জন চিকিৎসকও। পার্থর সঙ্গে এঁদের আলাপচারিতার ফাঁকেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়।
এ দিন দেবযানী ও কুকুরদের মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন পার্থ। জানিয়েছেন, কুকুর দু’টির নাম ছিল রিকি ও টেরি। পার্থ পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, কাকার পরিবারের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ভাল ছিল না। ২০০৫ সালে তাঁদের মা আরতিদেবী মারা যাওয়ার পর থেকে দেবযানীই সংসারের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেন। কিন্তু সম্প্রতি কাকা অরুণ দে-র সঙ্গে বাবা অরবিন্দ দে-র সম্পর্কের উন্নতির বিষয়টি ভাইবোন কেউই মেনে নিতে পারেননি। এ নিয়ে বিবাদ শুরু হয় পরিবারের অন্দরে। অগস্ট মাসের প্রথম দিকে সেই বিবাদ চরমে পৌঁছয়। এক দিন ঝগড়াঝাঁটি চলাকালীনই টেরি নামে পোষ্য কুকুরটি মারা যায়। সে দিন থেকে একই ফ্ল্যাটে বাবার থেকে আলাদা হয়ে থাকতে শুরু করেন দেবযানী-পার্থ। দিন পনেরোর মধ্যে রিকি নামের কুকুরটিও মারা যায়। পার্থ এ দিন জানিয়েছেন, কুকুরগুলি না খেয়েই মারা গিয়েছিল। কেন তারা খায়নি, তার ব্যাখ্যা অবশ্য তাঁর কাছ থেকে এ দিন মেলেনি।
পার্থ পুলিশকে জানিয়েছেন, দুই পোষ্যের দেহ সৎকার না করে ঘরেই রেখে দিয়েছিলেন দেবযানী। এর পর থেকেই উপোস করতে শুরু করেন তিনি নিজে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর জন্মদিনে বাবার দেওয়া উপহারও ফিরিয়ে দেন। ১৯৯৭ সাল থেকে দেবযানী যোগসাধনা শিখেছিলেন বলে পার্থ তদন্তকারীদের জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, গুরুর নির্দেশ ছিল পরিবারে সমস্যা হলেই যোগসাধনা করতে। তাই পারিবারিক সমস্যা মেটাতেই উপোস করে যোগসাধনা করতেন দেবযানী।
পার্থ তা হলে কী খেতেন? পুলিশকে তিনি জানিয়েছেন, তাঁর কাছে বেশ কিছু নগদ টাকা ছিল। নিরাপত্তারক্ষীদের দিয়ে শুকনো খাবার কেনাতেন। সেগুলো খেয়েই থাকতেন। ডিসেম্বরে দিদি মারা যাওয়ার পরেও ঘর ছেড়ে বেরোননি। কিন্তু চলতি বছরের জানুয়ারির শেষে টাকা ফুরিয়ে আসতে থাকে। তখন ফের বাবার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন পার্থ। কিন্তু তখনও বাবাকে দিদির মৃত্যুর খবর দেননি তিনি। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে মেয়ের মৃত্যুসংবাদ জানতে পারেন অরবিন্দ। পুলিশের একটি সূত্র বলছে, সৎকার না করে বাড়িতে কঙ্কাল রেখে দেওয়ানিয়ে অরবিন্দবাবু ও পার্থর মধ্যে গোলমালও হয়েছিল। কিন্তু অরবিন্দবাবু বিষয়টি পাঁচকান করতে চাননি বলেই পুলিশের ধারণা। এই কারণেই মারা যাওয়ার দু’দিন আগে তিনি পার্থ ও দেবযানীর নামে সম্পত্তি লিখে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বলে মনে করছে পুলিশ।
মেয়ের মৃত্যুই কি অরবিন্দবাবুকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দিয়েছিল?
পুলিশের অনুমান, সেটা একটা বড় কারণ হতেই পারে। তদন্তকারীরা এও বলছেন, বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত অরবিন্দবাবু শেষ দিকে আর্থিক সঙ্কটে পড়েছিলেন। তাই সম্পত্তি বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ তিনি একটি বড় সোনার দোকানে গিয়ে ৬ লক্ষ টাকার গয়নাও বিক্রি করেছিলেন। এই অনটনই আত্মহত্যার কারণ কি না, তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এ দিন বাড়িতে থাকা আরও কিছু ডায়েরি ও ক্যামেরার সন্ধান দিয়েছেন পার্থ। পুলিশ সেগুলো উদ্ধার করেছে। চিকিৎসকদের
সামনে পার্থ এ দিন বারবার নানা স্বগতোক্তি করেছেন। দিদির কথা উঠলে কখনও কখনও কেঁদে ফেলেছেন। কিন্তু বাবার মৃত্যু প্রসঙ্গে তেমন কোনও ভাবান্তর দেখা যায়নি তাঁর। মাঝে মাঝেই একটা কথা বলেছেন পার্থ, পিছনে ফিরে আর তাকাতে চান না তিনি। ফিরতে চান স্বাভাবিক জীবনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy