Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

চলন্ত সরকারি বাসে গান থামালেই উপর মহল থেকে ফোন!

বেসুরো গানটা ভাল লাগছিল না অনেকেরই। বাতানুকূল সরকারি বাসে একনাগাড়ে গান বেজে চলায় শেষমেশ আপত্তি জানালেন এক প্রবীণ। 

আড়াল: এসি বাসের জানলা ঢেকেছে বিজ্ঞাপনে। নিজস্ব চিত্র

আড়াল: এসি বাসের জানলা ঢেকেছে বিজ্ঞাপনে। নিজস্ব চিত্র

মেহবুব কাদের চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৩৪
Share: Save:

সরকারি বাতানুকূল বাসের মিউজিক সিস্টেম যেন ভীষ্মলোচন শর্মা! গানের দাপটে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেও তা থামানোর উপায় নেই!

বেসুরো গানটা ভাল লাগছিল না অনেকেরই। বাতানুকূল সরকারি বাসে একনাগাড়ে গান বেজে চলায় শেষমেশ আপত্তি জানালেন এক প্রবীণ।

কিন্তু বাসের চালক আর কন্ডাক্টর জানালেন, তাঁরা নিরুপায়। গান বন্ধ করা যাবে না। কারণ জানতে চাওয়ায় চালকের জবাব, ‘‘সরকারি নির্দেশ রয়েছে, চলন্ত বাসে কখনওই গান বন্ধ করা যাবে না। গান থামালেই উপর মহল থেকে ফোন আসবে।’’

রাজ্য পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, এ শহরে বাতানুকূল সরকারি বাসে মিউজিক সিস্টেম চালু করার জন্য পরিবহণ দফতর দরপত্র আহ্বান করেছিল বছর দু’য়েক আগে। প্রায় পাঁচটি বিজ্ঞাপন সংস্থা তাতে অংশগ্রহণ করে। সর্বাধিক টাকা দিয়ে বরাত পায় একটি সংস্থা। কসবার পরিবহণ ভবনে ‘সুরধারা’ নামে সেই প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী।

পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, শহরের প্রায় ২০০টি বাতানুকূল বাসে মিউজিক সিস্টেম চালানোর জন্য ওই বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে রাজ্য পরিবহণ দফতরের। মিউজিক সিস্টেম চালু রাখতে প্রতিটি বাসে ওই সংস্থার তরফে একটি করে মোবাইল ফোন রাখা হয়েছে। কোন কোন বাসে মিউজিক সিস্টেম চলছে বা বন্ধ রয়েছে, তা ওই সংস্থার মোমিনপুরের অফিস থেকে ‘জিপিএস’-এর মাধ্যমে নজরে রাখা হয়। এ ছাড়াও, শহরের ১৩টি সরকারি বাস ডিপোয় সকাল ছ’টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ওই সংস্থার কর্মীরা মোতায়েন থাকেন।

পরিবহণ দফতরের সঙ্গে ওই সংস্থার যে চুক্তি হয়েছে, তার অলিখিত শর্তই হল, বাসে মিউজিক সিস্টেম কখনওই বন্ধ রাখা যাবে না। বন্ধ রাখলেই খবর পৌঁছে যাবে কর্তাব্যক্তিদের কাছে। তখন এ নিয়ে কৈফিয়ত তলব করবেন তাঁরা। বিপাকে পড়বেন বাসের চালক ও কন্ডাক্টর।

বৃহস্পতিবার সকালে হাওড়া স্টেশন-যাদবপুর রুটের একটি বাতানুকূল সরকারি বাস (এসি-১) ছাড়া মাত্রই গান চালু হয়ে গেল। ভিড়ে ঠাসা বাসে ওই গান অনেক যাত্রীরই ভাল লাগছিল না। কিছু ক্ষণ সহ্য করার পরে গানটা থামাতে অনুরোধ করলেন ঢাকুরিয়ার বাসিন্দা, বছর সত্তরের অমিত দাস। বললেন, ‘‘এসি বাসে মোটা টাকা দিয়ে চড়ছি। আমার ভাললাগাটাও তো সরকারকে বুঝতে হবে।’’ নিরুপায় চালকের উত্তর, ‘‘দাদা, গান কিছুতেই বন্ধ করতে পারব না। মিউজিক সিস্টেম বন্ধ করলেই উপর মহল থেকে ফোন আসবে, কেন গান বন্ধ করা হল?’’ পরিবহণ দফতর সূত্রের খবর, মাস কয়েক আগে হাওড়া-পর্ণশ্রী রুটের (এসি-৪) বাসে গান বন্ধ রেখেছিলেন চালক। তখন চুক্তিবদ্ধ সংস্থার তরফে সংশ্লিষ্ট কর্মী পরিবহণ দফতরের আধিকারিকদের বিষয়টি জানান। অনেক জলঘোলা হওয়ার পরে রেহাই পান ওই চালক।

বছর দু’য়েক আগে ওই বিজ্ঞাপন সংস্থা পরিবহণ দফতরের সঙ্গে ‘সুরধারা’ প্রকল্পে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। তবে তারাও চুক্তির সমস্ত শর্ত মানছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। যেমন শর্ত অনুযায়ী, প্রতিটি স্টপে বাস থামার আগে জায়গার নাম ঘোষণা করার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না বলে অভিযোগ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবহণ দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘জায়গার নাম ঘোষণা হওয়াটা খুব প্রয়োজন। এখনও তা শুরু হল না।’’

কিন্তু গান চালালে তো সব সময়ে ভাল লাগতে না-ও পারে। সে ক্ষেত্রে কেউ আপত্তি করলেও গান বন্ধ করা হয় না কেন? ওই বিজ্ঞাপন সংস্থার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সৌরভ দাস বলেন, ‘‘বাসে অসুস্থ কেউ থাকলে মিউজিক সিস্টেম ‘মিউট’ করে দিতে বলেছি চালকদের। এ রকম ঘটনা অনভিপ্রেত।’’ তবে মিউজিক সিস্টেম একেবারে বন্ধ করার নিয়ম যে নেই, তা স্বীকার করে সৌরভবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘এই প্রকল্পে রাজ্য পরিবহণ দফতরকে বছরে প্রায় সত্তর লক্ষ টাকা দিই আমরা। এই সিস্টেমের মাধ্যমে যাবতীয় সরকারি দফতরের কাজের প্রচারও করা হয়।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এমনও হয়েছে, মিউজিক সিস্টেম বন্ধ করায় উল্টে কোনও সরকারি কর্মী আমাদের অভিযোগ জানিয়েছেন। তা হলে আমরাই বা কী করব?’’

যাত্রীদের ভাল না লাগলেও কি তাঁদের জোর করে গান শোনানো যায়? পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘এ বিষয়ে রাজ্য পরিবহণ নিগমের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বলুন।’’ ম্যানেজিং ডিরেক্টর নারায়ণস্বরূপ নিগমের কথায়, ‘‘যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্যই সরকারের কাছে প্রাধান্য। এমন কিছু ঘটে থাকলে তা ঠিক হয়নি। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব।’’

অন্য দিকে, অধিকাংশ এসি বাসের জানলা বিজ্ঞাপনে ঢেকে থাকায় সমস্যায় পড়ছেন যাত্রীরা। এক যাত্রীর অভিযোগ, ‘‘এসি বাসের জানলা বিজ্ঞাপনে ঢাকা থাকে। বাইরে কিছু দেখা যায় না। তাই জায়গা চিনতে অসুবিধা হয়। জানলায় বিজ্ঞাপন লাগানো উচিত নয়।’’ পরিবহণ দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘বিজ্ঞাপন থেকে সরকারের আয় হয়। তবে এসি বাসে যাতে বিজ্ঞাপন এড়ানো যায়, তা নিয়ে আগামী বৈঠকে কথা বলা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

AC Bus Music System irritation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE