বছরের প্রথম সপ্তাহের এক রাত। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সির সামনে থামল গাড়ি। ভিতরে কাতরাচ্ছেন সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। পড়ে গিয়ে মেরুদণ্ডে গুরুতর চোট। বহু চেষ্টায় স্ট্রেচার জোগাড় করে আত্মীয়েরাই কোনও রকমে টেনে বার করলেন তাঁকে। কিন্তু স্ট্রেচারে রোগীকে ওঠানো ও ভিতরে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। আত্মীয়দের বলা হল, ‘আপনারাই আনুন।’ রোগীকে কোনওমতে ভিতরে আনা হল। ইমার্জেন্সির ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালেন, ট্রমা কেয়ার সেন্টারে যেতে হবে।
ফের রোগীকে স্ট্রেচারে নিয়ে যাওয়া হল ট্রমা কেয়ার সেন্টারে। সেটিই এ রাজ্যে সরকারি পরিকাঠামোয় একমাত্র ট্রমা কেয়ার সেন্টার। গত নভেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিলিগুড়ির প্রশাসনিক ভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধন করেছিলেন।
সেখানে কী হল? রোগীর পরিজনেরা জানালেন, মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান করাতে বলা হল। হাসপাতাল চত্বরেই পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে গড়ে ওঠা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার পরে সেখানকার কর্মীরা বললেন, ‘‘সিটি স্ক্যান নয়। দরকার এমআরআই।’’ তার আগে এক্স-রে। এক দিকের এক্স-রে করার পরে রোগীকে পাশ ফেরানো দরকার। আত্মীয়দের বলা হল, ‘‘আপনারাই পাশ ফিরিয়ে দিন।’’ যেখানে রোগীর শরীরে হাত ছোঁয়ালেই তিনি চেঁচিয়ে উঠছেন, সেখানে তাঁকে পাশ ফেরানো হবে কী ভাবে? উত্তর এল, ‘‘সেটা আপনারা বুঝবেন।’’ এর পরে আর দেরি করেননি তাঁরা। রোগীকে নিয়ে হাজির হন এক বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানে এখন স্রোতের মতো টাকা খরচ হচ্ছে।
কিন্তু সরকারি পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও কেন যেতে হল বেসরকারি হাসপাতালে? রোগীরা পরিজনেরা জানান, সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামোর কথা জানতেন বলেই পৌঁছনোর আগে এক পরিচিতের মাধ্যমে ফোন করেছিলেন আর জি করের সর্বোচ্চ কর্তার কাছে। তাঁর সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। তিনি জানিয়ে দেন, রাতে কেউ কিছু শুনবে না। পরদিন সকালে ভর্তির ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু যন্ত্রণায় যিনি কুঁকড়ে যাচ্ছেন, তাঁকে সারা রাত ফেলে রাখা হবে? ওই কর্তার পরামর্শ, ‘‘পেন কিলার খাইয়ে রেখে দিতে পারেন।’’
রাজ্যের একমাত্র সরকারি ট্রমা কেয়ার সেন্টারের এই হাল কেন? কর্মীর অভাব? হাসপাতালের কর্তারা সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু জানাননি। বলেছেন, ‘‘আলাদা ভাবে ট্রমা কেয়ারের জন্য কর্মী বরাদ্দ নেই। হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের কর্মীরাই এখানে কাজ করেন।’’ তা হলে কি কাগজে-কলমে কোনও কর্মীই নেই এই সেন্টারের জন্য? সেটাও কিন্তু মানতে চাননি কর্তারা। তাঁদের দাবি, কোনও কাজই আটকাচ্ছে না। দিব্যি চলছে ট্রমা কেয়ার।
কেমন চলছে, তা অবশ্য ওই ঘটনাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
ট্রমা কেয়ার শুরুর শর্তই ছিল, গুরুতর জখম রোগীকে এক ছাদের তলায় তৎক্ষণাৎ চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া। সেই লক্ষ্য পূরণ করতেই কেটে গিয়েছে দশ বছর। বাম আমলে যে ভাবনার শুরু, ২০১২ সালে বর্তমান শাসকদল সেই চিন্তায় জোর দিলেও তা চালু হতে পেরিয়ে গিয়েছে অনেকটা সময়। তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে অবশেষে ২০১৫ সালে নিউরো-মেডিসিন ও নিউরো-সার্জারির ৫০টি শয্যা নিয়ে চালু হয় ট্রমা সেন্টারটি। দেরির কারণ হিসেবে বারবার অর্থাভাবের কথা জানিয়েছিল স্বাস্থ্য দফতর|
অস্থিরোগ চিকিৎসক এবং ট্রমা কেয়ার বিশেষজ্ঞ রামেন্দু হোমচৌধুরীর মতে, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রথম এক ঘণ্টা। যাকে বলা হয়, ‘গোল্ডেন আওয়ার’। তার মধ্যে চিকিৎসা শুরু হলে মৃত্যুর হার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমানো সম্ভব। তিনি বলেন, ‘‘নিয়ম হল, রোগী যখনই হাসপাতালে ঢুকছেন, তখনই তাঁকে স্ট্রেচারে নিয়ে যেতে প্রশিক্ষিত কর্মীরা এগিয়ে যাবেন। তাঁরাই আন্দাজ করতে পারবেন, কোন রোগীর চিকিৎসা কত দ্রুত শুরু হওয়া দরকার।’’
২২ নভেম্বর ভিডিও কনফারেন্সে আর জি করের ট্রমা কেয়ার পরিষেবার সূচনা করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, সরঞ্জামের অভাব নেই। একতলায় এক্স-রে, সিটি স্ক্যান, এমআরআই, পোর্টেবল আল্ট্রাসোনোগ্রাফি, মাইনর ওটি-র ব্যবস্থা। মোবাইল ওটি, জরুরি পরিষেবাও এই ভবনের একতলায় রয়েছে। দোতলা ও তিনতলার প্রতিটিতে তিনটি করে মোট ছ’টি অপারেশন থিয়েটার। পাঁচটি হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট হওয়ার কথা পাঁচতলায়। সেখানে ও ছ’তলায় রয়েছে আগে শুরু হওয়া নিউরো সায়েন্সের ৫০টি শয্যা। মহিলা ও পুরুষ ওয়ার্ড রয়েছে চার ও সাততলায়।
কলকাতা ও বিভিন্ন জেলা থেকে পথ দুর্ঘটনা-সহ বিভিন্ন কারণে আসা রোগীর ভিড়ে ইতিমধ্যেই কম পড়ছে শয্যা। সেখানে চিকিৎসক বা টেকনিশিয়ানের দুর্ব্যবহার এই প্রকল্পে কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে? হাসপাতালের অধ্যক্ষ শুদ্ধোদন বটব্যাল বলেন, ‘‘টেকনিশিয়ানদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কারণ, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের অধীনে তাঁরা। কিছু অভিযোগ এসেছে। আমরা নোট করছি। হাসপাতালের ভাবমূর্তি নষ্ট যাতে না হয়, তা দেখা হবে।’’ চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘ওই পরিবারকে লিখিত অভিযোগ জমা দিতে বলুন। প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্যও লিখিত অভিযোগ দেওয়ার চেনা ছকেই হেঁটেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এমনটা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। লিখিত অভিযোগ এলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব। ভবিষ্যতে চিকিৎসক ও কর্মীদের মানসিকতার পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রেও তা কার্যকর হবে।’’
লিখিত অভিযোগের অপেক্ষা না করে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নেবেন না কেন? অধ্যক্ষ বা স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার উত্তর মেলেনি।