চিকিৎসকের বালাই নেই, এমনকী গোটা ‘নেফ্রোলজি’ বিভাগটিই অকেজো, তা সত্ত্বেও পিপিপি মডেলে শ’য়ে-শ’য়ে কিডনি বিকল হওয়া গুরুতর অসুস্থ রোগীর ডায়ালিসিস হয়ে চলেছে কলকাতার একাধিক নামী সরকারি মেডিক্যাল কলেজে। চিকিৎসকদের নজরদারি ছাড়াই, স্রেফ ভাগ্যের ভরসায়! আর এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘আমি তো এ সব কিছুই জানতাম না!’’
সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, যে সব বেসরকারি সংস্থা সরকারি হাসপাতালে এই ডায়ালিসিস ইউনিট চালায় বাধ্যতামূলক ভাবে তাদের সেখানে প্রশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের রাখতে হয়। কিন্তু সেই নিয়ম গিয়েছে জলে। ডায়ালিসিসের জন্য চিকিৎসক না রেখেই দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাগুলি। স্বাস্থ্য দফতর নিজে অনেক হাসপাতালে ডায়ালিসিস ইউনিটে প্রশিক্ষিত ডাক্তার দিতে পারেনি এবং সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ বেসরকারি সংস্থা যখন একই কাজ করেছে তখন তাতেও চোখ বন্ধ করে থাকছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।
ডায়ালিসিস চলাকালীন রোগীর কোনও শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ কোন চিকিৎসক দেখবেন? রোগীর মৃত্যু হলে দায়ী হবে কে? পিপিপি মডেলে চুক্তিবদ্ধ সরকার ও বেসরকারি সংস্থা— দু’পক্ষই নিরুত্তর। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ দাবি করেছেন, অনিয়ম রুখতে অবিলম্বে নেফ্রোলজিস্ট বা ডায়ালিসিসের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চিকিৎসক নিয়োগ করতে চিঠির পর চিঠি দিয়েছেন তাঁরা। স্বাস্থ্য দফতর তোয়াক্কা করেনি। ফলে ওই সরকারি হাসপাতালগুলির ডায়ালিসিস ইউনিটে আসা রোগীদের কার্যত প্রাণ হাতে করে ডায়ালিসিস করাতে হচ্ছে।
যেমন, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে নেফ্রোলজি ইউনিট চালু হয় ২০১৪ সালের অগস্ট মাসে। সেখানে ডি-এম নেফ্রোলজি পাশ করা করা তিন জন চিকিৎসককেও আনা হয়েছিল। কিন্তু গত চার-পাঁচ মাসের মধ্যে তাঁরা সকলে বিভিন্ন হাসপাতালে বদলি হয়ে গিয়েছেন। অর্থাৎ ন্যাশনালে গত বেশ কয়েক মাস যাবৎ নেফ্রোলজি বিভাগটিই অকেজো। হাসপাতালে এক জনও নেফ্রোলজিস্ট নেই, নেই ডায়ালিসিসের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এমন অন্য চিকিৎসক যাকে আলাদা করে ডায়ালিসিসের জন্য রাখা হয়েছে। সেখানে পিপিপি মডেলে ডায়ালিসিস চালানো বেসরকারি সংস্থাও কোনও চিকিৎসক নিয়োগ করেনি। অথচ এই অবস্থায় প্রতি মাসে সেখানে গড়ে ২৫০-৩০০ রোগীর ডায়ালিসিস হয়ে যাচ্ছে!
কে দেখছেন এই রোগীদের? এঁদের কিছু হয়ে গেলে কী হবে? নেফ্রোলজিস্ট কোথায়? হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের জবাব, ‘‘যা হওয়ার হবে। আমরা কী করব? স্বাস্থ্যভবনে ডাক্তারের জন্য লিখে-লিখে হাত ব্যথা হয়ে গেল। তারা ব্যবস্থা না করলে আমাদের হাত-পা বাঁধা।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে আবার চমকে দেওয়ার মতো অন্য চিত্র। সেখানে এক জন মাত্র নেফ্রোলজিস্ট। নেফ্রোলজি বিভাগে ১৮টি শয্যা থাকলেও ইন্ডোর চলে না। এক জন নেফ্রোলজিস্ট শুধু একদিন আউটডোর করেন এবং সেখান থেকে ডায়ালিসিসের রোগী পিপিপি মডেলে চলা ডায়ালিসিস ইউনিটে পাঠান। যে সংস্থা ন্যাশনালের ডায়ালিসিস ইউনিটটি চালায় তারাই মেডিক্যালের দায়িত্বে রয়েছে।
মেডিক্যালের এক প্রশাসনিক কর্তার কথায়, ‘‘পুরো ব্যাপারটা গোলমেলে হয়ে রয়েছে। যখন রোগীদের ডায়ালিসিস হয়, তখন কোনও চিকিৎসক থাকেন না। সব ভগবানের ভরসায় চলছে। খাতায়-কলমে কিছু পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি-র ডিউটি ওই ইউনিটে দেখানো হয়, কিন্তু কস্মিনকালেও তাঁদের দেখা যায় না। আর ওই বেসরকারি হাসপাতালও জানিয়ে দিয়েছে, তারা যা লাভ করছে তাতে তাদের পক্ষে আলাদা করে ডায়ালিসিসে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চিকিৎসক নিয়োগ করা সম্ভব নয়।’’
মেডিক্যালের আর এক প্রবীণ চিকিৎসকের বক্তব্য, ‘‘এই হাসপাতালে আউটডোর থেকে রেফার হওয়া রোগীর ডায়ালিসিস হয়, কিন্তু খাতায় তাঁদের ‘অ্যাডমিশন’ দেখানো হয় না। অর্থাৎ হাসপাতালের নথিতে তাঁরা ‘অদৃশ্য’ থেকে যান। ওই সংস্থাকে বার-বার বলা হলেও তারা রোগীদের নাম পাঠায় না। ফলে বুঝতেই পারা যাচ্ছে, বিনা নজরদারিতে ডায়ালিসিস চলাকালীন কোনও রোগী সঙ্কটজনক হলে কাউকে দায়ী করা যাবে না। কাগজপত্র উদ্ধার করাটাই সমস্যা
হয়ে দাঁড়াবে।’’
কেন এই অবস্থা? প্রশ্ন করা হলে ওই সংস্থার প্রধান কাজল দত্তের জবাব, ‘‘আমাদের যা আয় হচ্ছে তাতে ডাক্তার রাখা অসম্ভব। স্বাস্থ্য দফতরও তো সব জায়গায় ডাক্তার দিতে পারছে না। তবে আমরা প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ানদের রাখি। তাঁরা খুব দক্ষ।’’ মেডিক্যালে ডায়ালিসিস রোগীদের ‘অ্যাডমিট’ দেখানো হচ্ছে না কেন, এ প্রসঙ্গে তাঁর উত্তর, ‘‘আমরা স্বাস্থ্য দফতরের নিয়ম মেনে কত ডায়ালিসিস করেছি সেই হিসেব স্বাস্থ্য দফতরেই পাঠিয়ে দিই। কার কার করছি সেটা পাঠানোর কথা বলা নেই। তাই অ্যাডমিশনের ব্যাপারটা বলতে পারব না।’’ ডায়ালিসিস চলাকালীন রোগীর কিছু হয়ে গেলে দায়ী কে হবে? কাজলবাবুর এ বার জবাব, ‘‘আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy