Advertisement
১১ মে ২০২৪
এনআরএস

যন্ত্রের টাকা বাড়ন্ত, নষ্ট হল প্লেটলেট

চার পাশে ডেঙ্গি রোগীদের জন্য প্লেটলেটের হাহাকার। বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্কে ঘুরেও তা জোগাড় করতে পারছেন না বহু মানুষ। এই পরিস্থিতিতে প্রায় ৫০ ইউনিট প্লেটলেট নষ্ট হল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে। প্লেটলেট মজুত রাখার যন্ত্র ‘প্লেটলেট অ্যাজিটেটর’টি বিকল হওয়াতেই বুধবার এমন ঘটেছে বলে হাসপাতাল সূত্রে খবর।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:৫৬
Share: Save:

চার পাশে ডেঙ্গি রোগীদের জন্য প্লেটলেটের হাহাকার। বিভিন্ন ব্লাড ব্যাঙ্কে ঘুরেও তা জোগাড় করতে পারছেন না বহু মানুষ। এই পরিস্থিতিতে প্রায় ৫০ ইউনিট প্লেটলেট নষ্ট হল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কে। প্লেটলেট মজুত রাখার যন্ত্র ‘প্লেটলেট অ্যাজিটেটর’টি বিকল হওয়াতেই বুধবার এমন ঘটেছে বলে হাসপাতাল সূত্রে খবর। ঘটনাচক্রে বুধবারই রাজ্যের অন্যতম প্রধান এই মেডিক্যাল কলেজে রক্তদাতাদের উৎসাহিত করার জন্য একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে হাজির ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী, নেতারাও। রক্তদান আন্দোলনকে উৎসাহিত করতে তাঁরা যখন মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছেন, তখনই ব্লাড ব্যাঙ্কে নষ্ট হচ্ছিল ‘অমূল্য’ প্লেটলেট!

বিষয়টি সামনে আসায় স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের বক্তব্য, পরিকল্পনার অভাবেরই খেসারত দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। পরিকল্পনার অভাবের কথা উঠছে কেন? স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘যেখানে যে টাকা খরচ করে যা যা কেনা উচিত, তা হচ্ছে না। এনআরএস হাসপাতালে হেমাটোলজি বিভাগ রয়েছে। ক্যানসার বিভাগও রয়েছে। রক্তের প্রয়োজন পড়ে অহরহ। সেখানকার ব্লাড ব্যাঙ্কে কেন একটা মাত্র প্লেটলেট অ্যাজিটেটর থাকবে? কেন সবেধন নীলমণি সেই যন্ত্রটি বিকল হতেই ত্রাহি ত্রাহি রব উঠবে? কেন হাসপাতাল থেকে বারবার বলা সত্ত্বেও আরও যন্ত্র কেনা হচ্ছে না? একটি যন্ত্র থাকলে সেটি যে কোনও সময়ে বিকল হয়ে এমন সমস্যা হতেই পারে, তা কি কেউ বুঝছেন না?’’

এনআরএস-এর এক কর্তা বলেন, ‘‘৪০ লক্ষ টাকা খরচ করে হাসপাতালের সুদৃশ্য গেট তৈরি হচ্ছে। কারণ মুখ্যমন্ত্রী চান, বাইরে থেকে হাসপাতালটা দেখতে যেন সুন্দর লাগে। এই ভাবনা বা প্রস্তাবকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, ৪০ লক্ষ টাকা যেখানে খরচ করা হচ্ছে, সেখানে তিন-চার লক্ষ টাকা খরচ করে একটা যন্ত্র কেনা যায় না? মুমূর্ষু রোগী হাসপাতালে ঢুকে কোনটা চাইবেন? ঝাঁ চকচকে গেট নাকি জীবনদায়ী রক্ত?’’

শুধু তা-ই নয়, ওই গেটটি তৈরি করতে গিয়ে প্যাথলজি বিভাগে রোগীদের ওয়েটিং রুমটিও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনার সেই গলদ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন ওই কর্তা।

কিছু দিন আগেও প্রয়োজনের তুলনায় রক্তের ঘাটতি ছিল রাজ্যে। প্রতি বছরই গরম কালে এবং পুজোর সময়ে এই ঘাটতি থাকে। সেই সঙ্কটের সময়ে যে যে সংগঠন রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেছিল, তাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন অনুষ্ঠান ছিল বুধবার। অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন মন্ত্রী শশী পাঁজা, বিধায়ক স্বর্ণকমল সাহা প্রমুখ। হাসপাতাল সূত্রে খবর, ওই দিন সকালে ব্লাড ব্যাঙ্কটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রয়েছে কি না, তা সরেজমিন দেখছিলেন ব্লাড ব্যাঙ্কের অধিকর্তা দিলীপ পাণ্ডা। তখনই তাঁর নজরে আসে অ্যাজিটেটরটি খারাপ। তড়িঘড়ি হাসপাতাল কর্তাদের কাছে খবর যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অনুষ্ঠান, তার আগে এমন সমস্যা কী ভাবে সামাল দেওয়া হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন সকলেই। স্থির হয়, সমস্ত প্লেটলেট বিলি করে দেওয়া হবে। সেই মতো যত ‘রিকুইজিশন’ এসেছিল, সবটাই দিয়ে দেওয়া হয়। তার পরেও কিছু প্লেটলেট উদ্বৃত্ত ছিল। সেগুলি বাধ্য হয়েই নষ্ট করতে হয়।

ব্লাড ব্যাঙ্কের অধিকর্তা দিলীপবাবু প্লেটলেট নষ্টের কথা স্বীকার করেননি। তিনি বলেন, ‘‘অন্য দিন যাঁরা ছ’টা প্লেটলেট চাইতেন, তাঁদের চারটে দিতাম। যাঁরা তিনটে চাইতেন, তাঁদের দুটো। বুধবার যে যা চেয়েছেন, সকলকে সব দিয়ে দিয়েছি। সন্ধ্যার মধ্যে যন্ত্র নির্মাণকারী সংস্থার লোকেরা এসে সারানোর ব্যবস্থাও করেছেন।’’

ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীরা অবশ্য জানান, অ্যাজিটেটর এমন একটি যন্ত্র, যেখানে প্লেটলেট সব সময়ে নড়ে। প্লেটলেট সঠিক ভাবে মজুত রাখতে ওই যন্ত্রে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় (২২ ডিগ্রি) রাখা জরুরি। টানা কয়েক ঘণ্টা যন্ত্র বিকল থাকলে প্লেটলেট খারাপ হয়ে যায়। এক কর্মী বলেন, ‘‘তড়িঘড়ি যারা চেয়েছেন, সকলকে প্লেটলেট দেওয়া হয়েছে। কিন্তু রাস্তা থেকে লোক ডেকে তো আর বিলি করা য়ায় না। উদ্বৃত্ত প্লেটলেট তাই ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।’’

ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মীরাই জানান, যে অ্যাজিটেটরে ৪৮টি প্লেটলেট থাকার কথা, সেখানে কখনও কখনও ১০০-১২০টি পর্যন্ত রাখা হয়। দিনের পর দিন এমন চলতে থাকলে যন্ত্র বিকল হবেই। ২০০৯ সালে এনআরএস-এ রক্তের উপাদান পৃথকীকরণ ইউনিটটি চালুর সময় থেকেই এই যন্ত্রটি রয়েছে। অতি-ব্যবহারের কারণেই বুধবার সেটি ‘বিদ্রোহ’ করেছিল বলে তাঁদের অনুমান।

রক্ত ফেলে দেওয়ার এমন নজির অবশ্য আগেও রয়েছে। খাস সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকেই এর আগে অব্যবহৃত রক্ত ফেলে দিতে হয়েছে। যৌনপল্লি থেকে রক্ত সংগ্রহ করে বিতর্কের মুখে পড়ে এর আগে বহু রক্ত নষ্ট করতে হয়েছে শহরের একাধিক মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাঙ্ককে। রক্তদান আন্দোলনের কর্মীদের মতে, সরকারের এই অবিবেচনার জেরে অনেকটাই ধাক্কা খায় আন্দোলন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE