Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

জালে কাকলির ঘনিষ্ঠ সিন্ডিকেট-চাঁই রুইস

বুধবারের ফল ছিল ১-১। বৃহস্পতিবার তা দাঁড়াল ২-১! বুধবার নিউটাউনের সিন্ডিকেট চক্রের দুই চাঁই সমীর সর্দার ওরফে ভজাই এবং হায়দার আলিকে গ্রেফতার করেছিল বিধাননগর পুলিশ। ভজাই স্থানীয় বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের অনুগামী বলে পরিচিত।

ধৃত রুইদাস মণ্ডল।

ধৃত রুইদাস মণ্ডল।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৫ ০৪:২৯
Share: Save:

বুধবারের ফল ছিল ১-১। বৃহস্পতিবার তা দাঁড়াল ২-১!

বুধবার নিউটাউনের সিন্ডিকেট চক্রের দুই চাঁই সমীর সর্দার ওরফে ভজাই এবং হায়দার আলিকে গ্রেফতার করেছিল বিধাননগর পুলিশ। ভজাই স্থানীয় বিধায়ক সব্যসাচী দত্তের অনুগামী বলে পরিচিত। হায়দার সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের শিবিরেই ঘোরাফেরা করেন। নিউটাউনে সাংসদ-বিধায়কের দ্বন্দ্ব বহু দিন ধরেই প্রকাশ্যে চলে এসেছে। তাই বুধবার রাতে পুলিশের একাংশের মন্তব্য ছিল, দিনের শেষে ফলাফল ১-১।

বৃহস্পতিবার সিন্ডিকেট চক্রের আর এক চাঁই রুইদাস মণ্ডল ওরফে রুইসকে আগ্নেয়াস্ত্র-সহ গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাঁর পাঁচ দিনের পুলিশি হেফাজত হয়েছে। রুইস আগে অধুনাপ্রয়াত এক প্রভাবশালী বাম মন্ত্রীর শিবিরে ছিলেন। তখন থেকে ওই এলাকায় এক বন্ধনীতে উচ্চারিত হত গৌর মণ্ডল ও রুইসের নাম। নন্দীগ্রাম পর্বে এক বড় মাপের তৃণমূল নেতাকে আক্রমণ এবং রাজারহাটে অস্ত্র-গুলির কারবারে রুইসের নাম উঠেছিল। কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পর তিনি কাকলিদেবীর শিবিরের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। গত লোকসভা ভোটের আগে শাসক দলের প্রচারেও তাঁকে দেখা গিয়েছিল। রুইসকে গ্রেফতারের পর এ দিন তাই বিধাননগর কমিশনারেটের কর্তারা বলছেন, বিধায়ক শিবিরের এক জনের বদলে সাংসদ শিবিরের দু’জন এখন হাজতে। অর্থাৎ ২-১!

ফলাফল যা-ই হোক না কেন, এখনও পর্যন্ত ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, নিউটাউনের সিন্ডিকেট চক্রের বড় মাথাদের ক্রমশ জালে পুরছে পুলিশ। অনেকের ধারণা, এর জেরে সিন্ডিকেট ব্যবসায় ক্রমশ তৈরি হচ্ছে একটা শূন্যস্থান।

কিন্তু প্রকৃতি ‘শূন্যস্থান’ পছন্দ করে না। তাই প্রশ্ন উঠেছে, এ বার কি সিন্ডিকেটে নতুন কোনও রাজনৈতিক সমীকরণ মাথা তুলবে? এই ব্যবসা যে প্রধানত শাসক দল ও সরকারের মদতে রমরমিয়ে চলে, তা সিপিএম থেকে তৃণমূল, দুই জমানাতেই পরিষ্কার। সেখানেই গুঞ্জন, এ বার কি শাসক তৃণমূলেরই অন্য কোনও ‘মাথা’ সিন্ডিকেট ব্যবসার ‘রিমোট কন্ট্রোল’ হাতে নেবেন?

নিউটাউনের থাকদাঁড়ি, মহিষবাথান, বালিগড়ির মতো সিন্ডিকেটের আঁতুড়ঘর ঘুরে এ দিন এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব মেলেনি। তবে এটা জানা গিয়েছে যে, তৃণমূল জমানায় কিছু দিন আগে পর্যন্ত সিন্ডিকেট ব্যবসা ‘নিয়ন্ত্রণের’ রাশ ছিল তৃণমূলের তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের হাতে। তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতারাই স্থানীয় ভাবে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতেন। সব্যসাচীও বরাবর মুকুল-ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত। ‘আমদানি-রফতানি’ সবটাই হতো মসৃণ এবং তুলনামূলক ভাবে ঝামেলাবিহীন। কারণ, দলের যে কোনও ছোটখাটো গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই সামলাতে পারতেন মুকুল।

কেমন ছিল মুকুলের সেই অবস্থান? নিজের সিন্ডিকেটের অফিসে রাখা একটি বিরাট মাপের গদিআঁটা চেয়ারে বসতেন না ভজাই। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘‘ওটায় মুকুলদা বসেছিলেন। আমি কি আর বসতে পারি!’’ মুকুলবাবু অবশ্য এ দিন সিন্ডিকেট নিয়ে একটি কথাও বলতে চাননি। ভজাই-হায়দার-রুইস প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে তাঁর জবাব, ‘‘আমি একটি কথাও বলব না।’’ তিনি মুখ খোলেননি সিন্ডিকেট রাজত্বের রাশ অন্য কোনও ‘যুবাপুরুষের’ হাতে চলে যাওয়ার গুঞ্জন নিয়েও।

এই গুঞ্জন জোরালো হচ্ছে রাজারহাট-নিউটাউনের স্থানীয় নেতাদের কথাতেও। তাঁদের একাংশ জানাচ্ছেন, নিউটাউনে লাগাতার বিধায়ক ও সাংসদ শিবিরের কর্মীদের মারামারির ঘটনা সামাল দিতে ইতিমধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক মন্ত্রী এবং এক সাংসদকে নিউটাউন দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই প্রসঙ্গেই সাম্প্রতিক একটি
ঘটনার কথা শুনিয়েছেন এক তৃণমূল নেতা। ছাড়পত্র পাওয়া নিয়ে রাজারহাট-নিউটাউন এলাকার একটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের মতান্তর হয়েছিল। স্থানীয় সূত্রের খবর, পরের দিনই এলাকার এক উঁচুদরের নেতা নাকি ফোন করে স্থানীয় নেতাদের জানান, মুখ্যমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ এক সাংসদ ওই প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দিতে বলেছেন।

সিন্ডিকেট সূত্রের খবর, বদল এসেছে সিন্ডিকেটের লভ্যাংশ বিলি-বণ্টনের পদ্ধতিতেও। এক সময় সিন্ডিকেটের লভ্যাংশ কে কতটা পাবে, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া ছিল। তাতে সিন্ডিকেটের চাঁই এবং স্থানীয় নেতাদের একটা বড় অংশ থাকত। লভ্যাংশের সিংহভাগ এখন সরাসরি উপরতলার নেতৃত্বের কাছে পৌঁছে দেওয়ার বার্তা এসে গিয়েছে।

তাতেই অশনি সঙ্কেত দেখছেন নিচুতলার সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যবসায়ীর বক্তব্য, আগেও লভ্যাংশের টাকা পার্টিকে দিতে হতো। কিন্তু এ বার তার ভাগ অনেকটাই বাড়বে। এক সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, এই ব্যবসা খারাপ নয়। আমাদের সংসার চলে সেই টাকায়। ভয় হচ্ছে, পার্টির ভাগ বেড়ে গেলে সংসার চালানো দায় হবে। হাজার পরিবার সিন্ডিকেট ব্যবসার উপরে নির্ভরশীল। পেটে টান পড়লে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় বলা মুশকিল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE