Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

এ বার পুলিশ আসবে, চিন্তা চম্পাহাটির গ্রামে গ্রামে

সোমবার সাতসকালে চম্পাহাটি সংলগ্ন হারাল গ্রামের মো়ড়ে চায়ের দোকানের জটলা। গোবিন্দপুরের বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ নিয়ে আলোচনা কিছুটা থমকে গেল অপরিচিত লোক দেখে।

হাহাকার: বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে মৃত দেবাশিস সর্দারের মা। সোনারপুরে। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

হাহাকার: বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে মৃত দেবাশিস সর্দারের মা। সোনারপুরে। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল

শুভাশিস ঘটক
শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৮ ০১:২৪
Share: Save:

সোমবার সাতসকালে চম্পাহাটি সংলগ্ন হারাল গ্রামের মো়ড়ে চায়ের দোকানের জটলা। গোবিন্দপুরের বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ নিয়ে আলোচনা কিছুটা থমকে গেল অপরিচিত লোক দেখে। তবে পুজোর আগে বাজির দরদাম করতে এসেছি শুনে কিছুটা আ‌শ্বস্ত জমায়েত। ধীরে ধীরে হাজির হলেন বাজির কারিগর এবং মহাজনেরা। এই মহাজনেরাই বাজি তৈরিতে টাকা লাগান।

এক মহাজনকে বলা হল, ‘‘গত বছর এক বন্ধুর সঙ্গে এসে চকলেটের জন্য অগ্রিম দিয়ে, পরে নিয়ে গিয়েছিলাম। এ বছর?’’ চাপা স্বরে তিনি বললেন, ‘‘আমাদের এলাকায় অধিকাংশেরই বাজি তৈরির লাইসেন্স নেই। রবিবার সোনারপুরে বিস্ফোরণের পর পুলিশ তো ঘন ঘন তল্লাশি চালাবে। ওটাই তো চিন্তা।’’

আর এক জন বললেন, ‘‘আমার বয়স এখন প্রায় ৫৫। জন্ম থেকেই দেখছি, বাবা-দাদা সারা বছর চকলেট, কালী পটকা, দোদমা তৈরি করছেন। ছোট ছেলেরাও বাজি তৈরিতে ওস্তাদ। সারা দিনে কাজের ফাঁকে বাড়ির বৌয়েরাও কয়েকশো চকলেট অনায়াসে তৈরি করে দেবে।’’ এক মহিলা বলে উঠলেন, ‘‘পুজোর আগে টাকার প্রয়োজন। সে জন্য এই সময় বাজি তৈরি করি।’’ তার পরেই ওই মহাজনকে বললেন, ‘‘দাদা, সোনারপুরের ঘটনার পর তো পুলিশ আমাদের গ্রামে ঢুকে তাড়াবে। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে গো!’’ প্রশ্ন করা হল, ‘‘বাজি তৈরিতে এত ঝুঁকি। অন্য কিছু করতে পারেন না।’’ ঝাঁজিয়ে উঠলেন ওই মহিলা, ‘‘আপনি কাজ দেবেন? কলকাতায় লোকের বাড়িতে গিয়ে খাটব নাকি?’’

দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাজির ‘আঁতুড়ঘর’ চম্পাহাটির সোলগোলিয়া, হারাল, চিনের মোড়, বেগমপুর-সহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে উপার্জনের একমাত্র পথ বাজি তৈরি। বড় রাস্তা থেকে কিছুটা দূরে আনাচে-কানাচে ছোট ছোট বাজির কারখানা। ওই সব কারখানার লাইসেন্স নেই। এলাকার এক বাজি-মহাজনের কথায়, ‘‘এক হাজার চকলেট বোমা তৈরি করতে পারলে দিনে ২০০ টাকা মজুরি। দিনে প্রায় পাঁচ থেকে ছ’হাজার চকলেট অনায়াসে তৈরি করে ফেলেন প্রায় সবাই।’’

ওই এলাকার বাসিন্দা এক আইনজীবীর কথায়, ‘‘এই এলাকায় চাষ-আবাদ তেমন হয় না। সারা বছর কেউ ভ্যান চালায়, কেউ জন মজুরের কাজ করে। তবে এলাকায় কয়েক প্রজন্ম ধরে বাজি তৈরির রেওয়াজ রয়েছে। সেটাই চলছে।’’ আর এক বাজি-মহাজনের কথায়, ‘‘গ্রামে বিকল্প অর্থনীতি গড়ে উঠেছে বলতে পারেন। আমরা যারা আর্থিক ভাবে সচ্ছল, তাঁরা মোটা টাকা খাটাই। আর যাঁরা আর্থিক অনটনে রয়েছেন, তাঁরা বাজি তৈরি করে টাকা পান।’’

যাঁরা বাজি তৈরি করেন, তাঁদের প্রশিক্ষণ আছে? ওই মহাজন বলেন, ‘‘প্রশিক্ষণ আবার কী? বাবার থেকে ছেলে শিখেছেন। তাঁর থেকে তাঁর ছেলে। প্রশিক্ষণ মানে তো ভাগ করা আর মাপ করে মসলা দেওয়া। দু’দিন পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে দেখলে আপনিও শিখে যাবেন। অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে। সে তো রাস্তায় হাঁটলেও গাড়ির ধাক্কায় মারা যেতে পারি।’’

জেলা পরিষদে ওই এলাকার তৃণমূল-সদস্য জয়ন্ত ভদ্র বলেন, ‘‘এ এক জটিল সমস্যা। এলাকার অধিকাংশ মানুষ গরিব। সব বাজি তৈরির উপর নির্ভরশীল। ওরা বৈধ ভাবে করছে না অবৈধ, তা বিবেচ্য নয়। মূল বিষয় হচ্ছে পেটের টান। বিকল্প রুজির কোনও ব্যবস্থাই তো করতে পারছি না।’’

বারুইপুর জেলা পুলিশের সুপার অরিজিৎ সিংহ শুধু বলেন, ‘‘সোনারপুরের ঘটনার পর উপর মহল থেকে কয়েকটি নির্দেশিকা এসেছে। তা প্রয়োগ করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Search Market Fire Cracker Village Police
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE