কলকাতা তথা বাংলারও আছে ভালবাসার রক্ষাকবচ।—ছবি পিটিআই।
কর্ণের জন্মগত বর্ম ছিল কবচকুণ্ডল। দেশের নানান প্রান্তে বিভেদের আগুন যতই জ্বলুক না কেন, কলকাতা তথা বাংলারও আছে এক অক্ষয় রক্ষাকবচ! সেই রক্ষাকবচ হল ভালবাসা।
সেই রক্ষাকবচের শক্তি টের পেয়েছেন কলকাতাবাসী এক কাশ্মীরি চিকিৎসক। সোশ্যাল মিডিয়া, সংবাদমাধ্যমে নানান ঘটনা দেখার পরে সেই রক্ষাকবচেই ভরসা রাখছে দু’প্রজন্ম ধরে এই মহানগরে বাস করা মধ্য কলকাতার এক কাশ্মীরি পরিবার। ভালবাসাকে সম্বল করেই কাশ্মীরিদের পাশে দাঁড়াতে তৈরি হয়েছে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে দল বেঁধেছেন এই শহরের এক দল নাগরিক। বিদ্বেষের পাল্টা হাতিয়ার তাঁদের ভালবাসা।
একই সুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘বাংলা সব থেকে শান্তিপ্রিয় রাজ্য। বাংলা সব সময় দেশপ্রেমকে শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে। এটা হল বাংলার সংস্কৃতি। বঙ্গভঙ্গের সময়েও রাখিবন্ধন করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সেতুবন্ধন করেছিলেন।’’
পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার পরেই হুমকির মুখে পড়েছেন পূর্ব কলকাতার বাসিন্দা, চিকিৎসক সোহেল গাজি (নাম পরিবর্তিত)। ঘটনার পরে তাঁকে দু’বার হুমকি দেয় মাথায় ফেট্টি বাঁধা কয়েক জন যুবক। দিয়েছে খুনের হুমকিও। ওই চিকিৎসক অবশ্য পুলিশে যাননি। বরং এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে হুমকির কথা জানতে পেরে তিলজলা থানাই পৌঁছে যায় তাঁর বাড়িতে। এ শহরে তিনি যে নিরাপদ, সেটাই তাঁকে বুঝিয়েছেন কলকাতার উর্দিধারী নিরাপত্তারক্ষীরা।
‘‘বিশ বছর হয়ে গেল, কলকাতায় আছি। এটাই তো আমার বাড়ি। আমার স্ত্রীও তো বাঙালি। কলকাতা ছেড়ে যাব কেন? এখানে সবাই আমাকে ভালবাসে। আমার পড়শিরাই আমাকে ঘিরে রেখেছে,’’ প্রত্যয়ী শোনাল ওই চিকিৎসককে। তাঁর বিশ্বাস, বাংলার মানুষ এ-সব বিভেদের কারসাজি মেনে নেবে না। বনগাঁর বাসিন্দা চিত্রদীপ সোম যেমন জানান, তাঁর উপরে হামলার কথা শুনে শুধু বন্ধুরা নয়, শহরের মানবাধিকার সংগঠন, বাম-তৃণমূল সব দলেরই নেতৃত্ব পাশে দাঁড়িয়েছেন।
পরিবার কাশ্মীরি হতে পারে, কিন্তু জন্মসূত্রে নিজেকে বাঙালি মনে করেন মধ্য কলকাতার এক তরুণী। ঝরঝরে বাংলাতেই বললেন, ‘‘এ-সব শুরু হওয়ার পর থেকেই বন্ধু, পড়শিরা নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছে। আমি তো জানি, কলকাতার সঙ্গে বিদ্বেষ কখনও খাপ খায় না। তাই নিশ্চিন্তে আছি।’’
শুধু নাগরিক কণ্ঠ নয়, ভালবাসার সুর শোনা যাচ্ছে লালবাজারের দুঁদে পুলিশকর্তার গলাতেও। জোর গলায় তিনি বলছেন, ‘‘সহিষ্ণুতা, একে অন্যকে ভালবাসাই কলকাতার ঐতিহ্য। ভুয়ো দেশপ্রেমের জিগির তুলে বিভেদ ঘটানোর চেষ্টাকে সহ্য করব না। এ শহরের সম্মান, ঐতিহ্য আমরা বজায় রাখবোই।’’ তাঁর মতে, অতীতের বিভিন্ন ঘটনায় দেখা গিয়েছে, পুলিশ তৎপর হওয়ার আগেই বিদ্বেষ মেটাতে সক্রিয় হয়েছেন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকেরা।
এ বারেও সেই তৎপরতা কিন্তু শুরু হয়েছে। পুলিশি সূত্রের খবর, রবিবার রাতে বেহালায় কয়েক জন কাশ্মীরি শালওয়ালাকে হেনস্থা করছিল এক দল উগ্র যুবক। স্থানীয় বাসিন্দারাই তাদের হটিয়ে ওই কাশ্মীরিদের থানায় নিয়ে যান। ভালবেসেই ওই কাশ্মীরিরা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে চাননি। নাগরিকদের অনেকেই বলছেন, বহু বছর ধরে শীত মানেই পাড়ায় কাশ্মীরি ফেরিওয়ালাদের অব্যর্থ হাজিরা। সেই বাঁধন ক্রেতা-বিক্রেতার সম্পর্ক ছাড়িয়ে আত্মীয়তায় পৌঁছে গিয়েছে। ‘‘সেই বাঁধন ছিঁড়বে কে,’’ প্রশ্ন তুলছেন সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া এক তরুণী।
সেই বাঁধনকেইও দৃঢ় করতে জোট বেঁধেছে ‘#কলকাতাফরকাশ্মীর’। প্রতিটি এলাকায় তাদের সদস্যেরা কাশ্মীরিদের আশ্রয় দিতে তৈরি। প্রচার চলছে নেটে। দেশ জুড়ে কাশ্মীরিদের নিরাপদ আশ্রয় দিতে চাওয়া ‘হিউম্যান নেটওয়ার্ক’ বা নাগরিক গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত অনেকেই জানাচ্ছেন, দেশের নানা প্রান্ত থেকে কাশ্মীরিরা নিরাপত্তা আশঙ্কার কথা জানালেও কলকাতা থেকে কোনও আবেদন পাননি তাঁরা। শুনে কলকাতা বলছে, ভালবেসেই নিভিয়ে দেবো বিদ্বেষের আগুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy