Advertisement
১১ মে ২০২৪
রিজেন্ট পার্ক

ঝাঁ চকচকে, তবুও কমেনি মশার উপদ্রব

কিছু মানুষ, কিছু সম্পর্ক আর কিছু অনুভূতি— এই নিয়েই আমার পাড়া। সেখানে কখনও মিলমিশ, কখনও বা খুঁটিনাটি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক। কখনও প্রাণ খোলা হাসি কখনও বা মান অভিমান। এরই সঙ্গে মিশে আছে এক আকর্ষণী শক্তি যা ধরে রেখেছে সকলকে একটা যৌথ পরিবারের মতো।

শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৬ ০১:১৭
Share: Save:

কিছু মানুষ, কিছু সম্পর্ক আর কিছু অনুভূতি— এই নিয়েই আমার পাড়া। সেখানে কখনও মিলমিশ, কখনও বা খুঁটিনাটি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক। কখনও প্রাণ খোলা হাসি কখনও বা মান অভিমান। এরই সঙ্গে মিশে আছে এক আকর্ষণী শক্তি যা ধরে রেখেছে সকলকে একটা যৌথ পরিবারের মতো।

আমার পাড়া রিজেন্ট পার্ক। বৃহৎ এই এলাকায় আছে ছোট বড় বহু পাড়া। তারই মাঝেই আমার নিজের পাড়া রিজেন্ট পার্ক গভর্নমেন্ট হাউজিং এস্টেট। একটা পূর্ণাঙ্গ পাড়াই বটে। যেখানে ন’শো পরিবারে থাকেন কয়েক হাজার মানুষ। বৃহৎ এই আবাসনের এক দিকে সরকারি, অন্য দিকে, বেসরকারি আবাসনগুলি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। তারই মাঝে অসংখ্য গাছগাছালিতে সবুজের সমাহার। রয়েছে মানুষে মানুষে নিবিড় যোগাযোগ, সুখে দুঃখে পাশে থাকার অভ্যাস।

কাছেই রানিকুঠি অঞ্চল, আর কিছুটা দূরে রানিদিঘি। কাছাকাছির মধ্যেই তিলকনগর, আজাদগড় এলাকা। আমি বাঁকুড়ার ছেলে। বরাবরই শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ আমায় আকৃষ্ট করে। তেরো বছর আগে যখন এ পাড়ায় এসেছিলাম তখন সবুজে ঘেরা এই আবাসনে খুঁজে পেয়েছিলাম পছন্দের সেই শান্ত, নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশ।

এখানে ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে। ধোঁয়া ওঠা চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়েই প্রতি দিন বেরিয়ে পড়ি। গাছের ছায়ায় পাখিদের গান শুনতে শুনতে দিব্যি সেরে ফেলি প্রাতর্ভ্রমণটা। সত্যি বলতে কি সামনেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস রোডে এত যানজট, গাড়ির হর্নের কর্কশ আওয়াজে সকাল সকাল ও দিকটায় যেতে মন চায় না।

সকাল থেকেই শুরু হয় এ পাড়ার আড্ডা। কখনও পাড়ার মোড়ে, কখনও চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চ পেতে কখনও বা আবাসনের গাছের ছায়ায়। বিকেলে চোখে পড়ে প্রবীণদের আড্ডা। তবে ছুটির দিনে বেশি মানুষকে আড্ডা দিতে দেখা যায়। আসলে আড্ডাটা আছে বলেই মানুষে মানুষে যোগাযোগ আজও আছে। সেই আকর্ষণেই প্রতি দিন কিছু মানুষ নির্দিষ্ট ঠিকানায় সময় মতো হাজির হয়ে যান।

এলাকায় উদ্যানের সংখ্যা কম। আবাসনের মধ্যে রয়েছে একটি উদ্যান। এখানে খেলতে আসে বাইরের ছেলেরাও। তবে আগের চেয়ে কমেছে ছোটদের খেলার অভ্যাসটা। তাদের বিকেল-সন্ধ্যাটা এখন কোচিং-এর কারাগারে রুদ্ধ। কেউ কেউ আবার বাড়িতে বসে ডেস্কটপে ক্রিকেট, ফুটবল খেলতে ভালবাসে। কেউ বা শুধুই টিভির পর্দায় খেলা দেখে। আর যারা শরীরচর্চায় আগ্রহী তারা ছোটে পছন্দের অভিজাত জিমে।

আগে এই অঞ্চলে মূলত দেশভাগের রক্তক্ষয়ী অভিজ্ঞতায় ভিটেমাটি হারা মানুষের বসবাস ছিল। সময়ের সঙ্গে লোকসংখ্যা বাড়ায় এলাকার পুরনো ছবিটাই বদলে গিয়েছে। এখন মধ্যবিত্তের পাশাপাশি থাকেন উচ্চমধ্যবিত্তরা। এসেছেন অবাঙালিরাও। এলাকাটা এখন জমজমাট। পুরনো বাড়িগুলি ভেঙে তৈরি হচ্ছে ঝাঁ চকচকে বহুতল। অদূর ভবিষ্যতে এমন একটা দিন আসবে যখন হাতে গুনে বলে দেওয়া যাবে এ অঞ্চলে কটা বাড়ি আছে। দিনে দিনে বাড়ছে ঝলমলে দোকানও। কী নেই সেই তালিকায়? অভিজাত রেস্তোরাঁ থেকে বিলাসবহুল জিনিসপত্রের দোকান।

মনে পড়ে টালিগঞ্জ পর্যন্ত মেট্রো চলাচল শুরু হওয়ার পর থেকেই এলাকাটার উন্নতি হয়েছে। আর কবি সুভাষ পর্যন্ত পাতাল রেল সম্প্রসারণের পরে এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থাও যেমন উন্নত হয়েছে তেমনই বেড়েছে জমির দামও। এখন এ অঞ্চলে জমির দাম আকাশ ছোঁয়া।

অন্য পাড়ার মতোই এখানেও মিলছে উন্নত নাগরিক পরিষেবা। এন এস সি বোস রোডের ধারে কয়েক বছর আগেই বসেছে ত্রিফলা আলো। নিয়মিত রাস্তা পরিষ্কার, জঞ্জাল সাফাই হয়। এলাকায় উন্নয়ন চোখে পড়ে। মিটেছে গরমে পানীয় জলের সমস্যাও। রাস্তাঘাটের অবস্থাও আগের চেয়ে ভাল।

তবে কিছু সমস্যাও আছে। আমাদের আবাসনের সামনে এন এস সি বোস রোডে কমবেশি সব সময় যানজট থাকায় গাড়ি নিয়ে ঢুকতে বেরোতে সমস্যা হয়। কমেনি মশার উপদ্রব। রাজপথের দু’ধারে ঠাসা দোকান। বেশির ভাগ জায়গায় ফুটপাথ দিয়ে হাঁটা গেলেও কি‌ছু কিছু জায়গায় দোকানের জিনিসপত্র ফুটপাথে রাখায় হাঁটতে অসুবিধা হয়।

কাছাকাছির মধ্যে বেশ কিছু নামকরা পুজো হয়। আমাদের আবাসনের পুজোটিও কম আকর্ষণীয় নয়। সেখানে ষষ্ঠী থেকে দশমী খাওয়াদাওয়ার পাশাপাশি হয় সাংস্কৃতিক আনুষ্ঠান। আসেন জনপ্রিয় শিল্পীরাও। ভাল লাগে সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে। পুজো-পার্বণের পাশাপাশি সারা বছর লেগে থাকে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। কাছাকাছির মধ্যে কিছু পাড়ার ক্লাবের উদ্যোগে স্বাস্থ্য শিবির, রক্তদান শিবিরও হয়।

অন্য পাড়ার মতোই এখানেও থাকেন বহু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। কর্মসূত্রে তাঁদের ছেলে-মেয়েরা বাইরে থাকলেও মানুষে মানুষে সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ থাকায় কেউ অসহায় বা একাকীত্ব বোধ করেন না। তেমনই কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বা অন্য কোনও সমস্যায় সকলেই পাশে থাকেন।

কাছাকাছির মধ্যে বাঁশদ্রোণী ও আজাদগড় বাজার। অনেক রাত পর্যন্ত এই এলাকায় দোকানপাট খোলা থাকে। এখানে থাকার সব চেয়ে বড় সুবিধা উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা।

এখনও রাস্তায় বেরোলে পরিচিতেরা সৌজন্য বিনিময় করেন, সময় থাকলে এগিয়ে এসে দু’চার কথাও বলেন। কাজের অজুহাত দেখিয়ে কেউ কাউকে উপেক্ষা করেন না। এখানেই থাকতেন নাট্যকার মোহিত চট্টোপাধ্যায়, সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী, বরুণ সেনগুপ্ত, প্রাক্তন মন্ত্রী প্রশান্ত শূর প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি। এখন থাকেন ফুটবলার শ্যাম থাপা, প্রদীপ চৌধুরী এবং অভিনেত্রী শকুন্তলা বড়ুয়া।

বহু বার অন্যত্র থাকার সুযোগ এলেও আমাদের এই আবাসন বা এই পাড়াটা ছাড়ার কথা ভাবতে পারিনি। তার একমাত্র কারণ এখানকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। ক্লান্ত দিনের শেষে এখানেই পাই স্বস্তির আমেজ। সেটাই বড় প্রাপ্তি।

লেখক পরিচিত চিকিৎসক
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

santanu bandyopadhyay Regent Park
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE