Advertisement
১৭ জুন ২০২৪

‘কারখানার জমিতে শ্মশান!’

পুর কর্তৃপক্ষ অবশ্য আশ্বাস দিচ্ছেন, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন দিয়েই জমি কেনা হবে। জমির মালিকানাও যাচাই করে দেখা হবে।

উদ্বিগ্ন: সিরিটি শ্মশান সম্প্রসারণের পরিকল্পনায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে প্লাস্টিক কারখানার কর্মীদের ভবিষ্যৎ। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

উদ্বিগ্ন: সিরিটি শ্মশান সম্প্রসারণের পরিকল্পনায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে প্লাস্টিক কারখানার কর্মীদের ভবিষ্যৎ। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

দেবাশিস ঘড়াই
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৮ ০১:৩৯
Share: Save:

কারখানা উঠে শ্মশান হবে! কথাটা শুনে মুখে একরাশ অবিশ্বাস, বিস্ময়! তবে সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। তার পরেই বিপন্ন স্বরে প্রশ্ন, ‘‘আমরা কোথায় যাব? মা-স্ত্রী-ছেলেমেয়ে, সকলের কী হবে?’’

আশপাশে প্লাস্টিকের বস্তা। সেই বস্তার মধ্যেও প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ভর্তি। ভিতরে মেশিন। তার মধ্যে দাঁড়িয়েই মুখে একরাশ আতঙ্ক, অবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্নটা করলেন সিয়ারাম যাদব। টালিগঞ্জের বসন্ত লাল সাহা রোডে সিরিটি শ্মশানের পিছনেই প্লাস্টিক ‘রিসাইক্লিং’-এর কারখানায় পঁচিশ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি। কর্মজীবনের উপান্তে এসে স্বাভাবিক ভাবেই সিয়ারামের প্রশ্ন, ‘‘এখন কাজ চলে গেলে যাব কোথায়?’’

সিয়ারামের এই প্রশ্নের কারণ, সিরিটি শ্মশান সম্প্রসারণের জন্য কলকাতা পুরসভা শ্মশান সংলগ্ন আট কাঠা জায়গা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট জমির মালিকের সঙ্গে কথাবার্তাও প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। ওই জমিতে প্লাস্টিকের কারখানাটি ছাড়াও আরও একটি কারখানা রয়েছে। সেটি কাঠের টেবিল তৈরির। এ ছাড়াও একটি গুদাম বহু বছর বন্ধ পড়ে রয়েছে। কারখানাগুলি ভাড়াটে হিসেবে ওই জমিতে রয়েছে বলে জানাচ্ছে পুরসভার নথি। প্রস্তাবিত সম্প্রসারিত শ্মশানে ওই সব কারখানাই শ্মশানের অংশ হয়ে যাবে।

শুধু সিয়ারামই নন, ওই কারখানার আরও দুই কর্মী অজয়কুমার যাদব ও বেচান যাদবের একই প্রশ্ন। তাঁরাও দীর্ঘ দিন ধরে ওই কারখানায় কাজ করছেন। অজয় বললেন, ‘‘পরিবার বিহারে আছে। আমরা তো কিছু জানিও না।’’ তাঁরা না জানলে কী হবে! জমির এক মালিক বিমল সাঁতরার সঙ্গে পুর কর্তৃপক্ষের ইতিমধ্যেই কথা হয়ে গিয়েছে। কাঠা পিছু আট লক্ষ টাকার বিনিময়ে ওই জমি পুরসভাকে দিতে তিনি সম্মতও হয়েছেন। বিমলবাবুর কথায়, ‘‘যে তিন ভাড়াটে রয়েছেন, তাঁরা দীর্ঘ কয়েক বছর ভাড়া দিচ্ছেন না। অনেক বার বলা সত্ত্বেও তাঁরা আলোচনায় বসেননি। পুরসভার সঙ্গে আমার জমি বিক্রির কথা হয়েছে।’’ তবে তার জন্য কারখানার ক্ষতি হবে, লোকের কর্মসংস্থানের হানি হবে তা মানতে রাজি নন বিমলবাবু। বিমলবাবু বলেন, ‘‘কেউ বিনা ভাড়ায় ব্যবসা করার পরে যদি ঠিক করেন যে জমি চলে গেলে ব্যবসা বন্ধ করে দেবেন, তা হলে তো আমার কিছু করার নেই। অন্যত্র ব্যবসা করতেই পারেন।’’

প্লাস্টিকের কারখানার মালিক অরিন্দম দাস জানাচ্ছেন, কারখানা ভেঙে যে শ্মশান হবে, তা তাঁরা বিন্দুমাত্র জানেন না! উল্টে তাঁরা ভাড়া দেন না, বিমলবাবুর এই দাবিকে নস্যাৎ করে দিয়ে অরিন্দমবাবুর পাল্টা দাবি, ‘‘আমাদের ট্রেড লাইসেন্স, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্র, ফায়ার লাইসেন্স সবই আছে। ভাড়া দিই রেন্ট কন্ট্রোলে, তার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে।’’

প্লাস্টিকের কারখানার পাশেই রয়েছে কাঠের টেবিল তৈরির কারখানা। সেখানকার কর্মী বাচ্চু দাস বললেন, ‘‘৪০ বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করছি। কিছু জানতে পারলাম না। আমাদের নিয়ে সকলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল!’’ তার পরেই বাচ্চুর স্বগতোক্তি, ‘‘সরকার জমি নিতে চাইলে তো কেউ আটকাতে পারব না। কিন্তু আমাদের কথাটাও তো ভাবতে হবে।’’ ওই কারখানার মালিক অনিল কর্মকার বলেন, ‘‘জমির মালিক ছিলেন কার্তিক সাঁতরা। তিনি মারা যাওয়ার পরে কে জমির মালিক, সেটা তো পরিষ্কার করে বলতে হবে। তা হলে তাঁর সঙ্গে কথা বলব। তার পরে আইন মেনেই যা হওয়ার হবে।’’ অনিল জানালেন, কারখানাগুলিতে সব মিলিয়ে কমপক্ষে ৩০ জন কর্মী রয়েছেন। সকলের পরিবারই কারখানার উপরে নির্ভরশীল।

পুর কর্তৃপক্ষ অবশ্য আশ্বাস দিচ্ছেন, উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন দিয়েই জমি কেনা হবে। জমির মালিকানাও যাচাই করে দেখা হবে। এক পদস্থ আধিকারিকের কথায়, ‘‘কারও যাতে ক্ষতি না হয়, সেটা সব সময়ই মাথায় রাখা হচ্ছে।’’ স্থানীয় কাউন্সিলর কৃষ্ণা সিংহ বলছেন, ‘‘জনস্বার্থেই শ্মশানের সম্প্রসারণ করা হবে। আশপাশের তিনটি বরো মিলিয়ে এই একটিই শ্মশান। তাই জায়গা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।’’ বিষয়টি নিয়ে মেয়র পারিষদ তারক সিংহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে পুরসভা সূত্রের খবর।

তবে সে বৈঠকের পরিণতি কী হবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত নন সিয়ারামেরা। তাঁদের একটাই প্রশ্ন, ‘কারখানা উঠে শ্মশান হবে?’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Siriti Crematorium Land expansion Factory
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE