সকাল এগারোটা। রাতে পুড়ে যাওয়া বন্ধ জেসপ কারখানার তিন তলার শেড থেকে তখনও ধোঁয়া বেরোচ্ছে। ২৮ নম্বর গেট দিয়ে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে ঢুকল দমকলের গাড়ি। হতাশ দৃষ্টি নিয়ে কারখানা চত্বরে যেখানে অর্ধ নির্মিত লোকাল ট্রেনের কামরা ও মোটা মোটা তামা, লোহার যন্ত্রাংশ রয়েছে সেখানে জটলা করছেন জেসপের কর্মীরা। কারখানা চত্বরের দখল নিয়েছে পুলিশ আর দমকল।
মোটের উপরে মঙ্গলবার সকাল থেকে এমনটাই ছিল জেসপ কারখানার চিত্র। কারখানায় যেখানে রং, জেনারেটরের তেল, বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম-সহ অন্যান্য রাসায়নিক রাখা ছিল, সোমবার রাতে সেখানেই আগুন লাগে। সেই আগুন নাশকতার কারণে না দুর্ঘটনাবশত, মঙ্গলবার সকাল থেকে তা নিয়েই জল্পনা চলছিল কারখানা চত্বরে। কর্মীদের অনুমান, চার থেকে পাঁচ কোটি টাকার জিনিসপত্র পুড়ে গিয়েছে।
সোমবার রাতে রাজ্যের দমকলমন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দাবি করেছিলেন, ওই অগ্নিকাণ্ডের পিছনে নাশকতা কাজ করেছে। কারখানার মালিক পবন রুইয়ার বিরুদ্ধে যে রাজ্য সরকার আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে, রাতেই তা স্পষ্ট জানিয়েছিলেন দমকলমন্ত্রী। ফলে মঙ্গলবার সকাল থেকেই কারখানার কর্মীরা পুলিশ প্রশাসনের উপরে দ্রুত এই অগ্নিকাণ্ডের রহস্য ভেদ করার জন্য চাপ তৈরি করতে থাকেন। পুলিশ কর্তারাও মানছেন যে, যেখানে বিদ্যুতের কোনও সংযোগ নেই, সেখানে শর্ট সার্কিটের প্রশ্নই ওঠে না। ফলত ঘটনার পিছনে অন্তর্ঘাতের প্রশ্নই উঠছে জোরালো ভাবে।
দমদমের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসুও মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে এসে জেসপের মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। ব্রাত্যবাবু বলেন,‘‘কারখানার কর্মীদের স্বার্থ দেখা এবং মালপত্র চুরি যাওয়া বন্ধ করতে একাধিক বার মালিকপক্ষ ও কর্মীদের নিয়ে আলোচনায় বসেছিলাম। ওঁরা কিচ্ছু করেননি। মালিকপক্ষের এত নিরুত্তাপ ব্যবহারই আজ অনেক প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।’’
সোমবার রাতে দমকলমন্ত্রী শোভনবাবু জানিয়েছিলেন, কারখানার ভিতরের পরিবেশের জন্য দমকলকে আগুন নেভানোর কাজে এসে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। তাঁর সেই বক্তব্যের সত্যতা টের পাওয়া গেল মঙ্গলবার দিনের আলোয় কারখানা চত্বরে গিয়ে। দেখা গেল, বড় বড় গাছ আর জঙ্গলে ভরে রয়েছে চারদিক। সেই জঙ্গল এতটাই ঘন যে মাত্র কয়েক মিটারের মধ্যেই কিছু দেখা যায় না। কারখানার গেটে জড়ো হওয়া কর্মীরাই অনেককে সতর্ক করলেন সাপের কারণে যত্রতত্র না ঘোরাঘুরি করতে।
কর্মীরা জানালেন, রাজ্য সরকার জেসপ অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে গত ফেব্রুয়ারি থেকে সরকারের তরফে প্রত্যেক কর্মচারীকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে ৪৯৬ জন কর্মচারী রয়েছেন সেখানে। তাঁরা জানান, ভারতে ট্রেনের কামরা তৈরির অন্যতম কারখানাই ছিল জেসপ। এক সময় লোডশেডিং হলে গোটা দমদম এলাকাকে বিদ্যুৎ দেওয়া ক্ষমতা রাখত জেসপ। ঘড়ির বদলে দমদমের মানুষ এক সময়ে সময়ের হিসেব রাখতেন কারখানার সাইরেনের শব্দ শুনে।
কারখানার তৃণমূল পরিচালিত কর্মী সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে নেওয়ার পরে রুইয়া গোষ্ঠী শুধু কেন্দ্রের টাকা তছরুপ করে কারখানা শেষ করে দিল। ২০০৯ সালের পরে কেন্দ্র রুইয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তির পুনর্নবীকরণ করল না। কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। এখন ওঁরাই কারখানার ভিতর চুরি করাচ্ছে। আমাদের কাছে সব প্রমাণ রয়েছে।’’
কর্মীরা জানান, জেসপের বিভিন্ন পাঁচিলে অন্তত ৮০টি বড় বড় গর্ত তৈরি করেছে দুষ্কৃতীরা। যার মধ্যে দিয়ে রাতের অন্ধকারে যন্ত্রাংশ চুরি হয়। পুলিশ তল্লাশিতে গেলে জঙ্গলের মধ্যে থেকে অন্ধকারের মধ্যে পাথর আর বড় বড় লোহার নাট উড়ে আসে পুলিশের উদ্দেশে। এতটাই দুর্ধর্ষ দুষ্কৃতীরা।
ঘটনাস্থলে এসে ব্যারাকপুর কমিশনারেটের পুলিশ কমিশনার তন্ময় রায়চৌধুরী জানান, জেসপের ভিতরকার যন্ত্রাংশ রক্ষা করার জন্য পুলিশি নিরাপত্তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের ১২টি দল শুধুমাত্র জেসপের নিরাপত্তার জন্য এ বার থেকে কাজ করবে। যারা লাঠি, রবার বুলেটের মতো জিনিস নিয়ে জেসপের বিভিন্ন জায়গায় পাহারায় থাকবে। কারখানায় চুরি রুখতে দুষ্কৃতীদের দেখা মাত্র পুলিশ যাতে গুলি চালায়, পুলিশ কমিশনারের কাছে সেই দাবিও জানান কর্মীরা। তবে সেই দাবি নাকচ করে দেন তন্ময়বাবু। কারখানার কর্মীরা পুলিশ সুপারকে জানান, জেসপের পাহারায় পুলিশকে তাঁরাও পালা করে সহযোগিতা করবেন।
পুলিশ সুপার জানান, মালিকপক্ষকে হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল কারখানা চত্বরের জঙ্গল পরিষ্কার করে আলোর ব্যবস্থা করতে। কিন্তু তার কিছুই হয়নি। তবে এখন কারখানার ভিতরের জঙ্গল পরিষ্কার করে সেখানে আলোর ব্যবস্থা করা যায় কি না, সে জন্য মন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে অনুরোধ করেন পুলিশ সুপার। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়েই ব্রাত্যবাবু দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান হরিন্দর সিংহ এবং ভাইস চেয়ারম্যান বরুণ নট্টকে নির্দেশ দেন অবিলম্বে কারখানার ভিতরের জঙ্গল পরিষ্কারের কাজ শুরু করতে। সেই মতো মঙ্গলবার দুপুর থেকেই দমদম পুরসভা জেসপের জঙ্গল কাটার কাজ শুরু করে দেয়।
বুধবার সকালে জেসপ চত্বরে কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের বৈঠকও হওয়ার কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy