গত বছর নেপালের ভূমিকম্পের পরে ভয়টা রীতিমতো কাবু করে ফেলেছিল। এ বছরের প্রথম সোমবার কাকভোরে সেই আতঙ্কই যেন বিভীষিকা হয়ে উঠল।
নিউ টাউনে বাইশতলায় সাজানো ফ্ল্যাটের জানলায় ‘ভেনেশিয়ান ব্লাইন্ড’-এর দিকে তাকালেই এখনও বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠছে লেখক সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। জানলার সেই খড়খড়িই ঝনঝনিয়ে বারবার দেওয়ালে ধাক্কা দিচ্ছিল। শীতকালের শেষ রাত্তিরের সব থেকে গাঢ় ঘুমটাও তাতে পুরো চৌপাট। তখন লিফ্ট চলার প্রশ্ন নেই। দুলুনি আর ঝাঁকুনিতে বেসামাল হয়ে অগত্যা বাইশতলার সিঁড়ি ভেঙেই নামতে হল।
কালিকাপুরের একটি আবাসনের বাসিন্দা, দেশবন্ধু সিংহরায়ের অভিজ্ঞতাও কম রোমহর্ষক নয়। পোষ্য সারমেয় পুপু মাঝরাত্তিরে নাগাড়ে ভৌ-ভৌ করে চলেছে শুনে প্রথমটা বাড়িতে চোর ঢুকেছে ভেবেছিলেন তিনি। তার পরে জানলার পাল্লাগুলো কাঁপছে শুনেই কী ঘটছে বুঝে ফেলেন। অতএব স্ত্রী-কন্যাকে চটজলদি ঘুম থেকে ঠেলে তুলে পুপুকে কোলে করে পড়ি-কী-মরি করে নীচে নেমে আসা! ঠান্ডায় গাড়ির মধ্যে ঢুকে বসেছিল গোটা পরিবার। কাজের সূত্রে আন্দামানে গিয়ে ভূমিকম্প ও তার ‘আফটার শক’-এর সঙ্গে পরিচিত হলেও দেশবন্ধুবাবুর ভয় কাটছে না। বলেন, ‘‘বাইরে বেরিয়েও দেখলাম, সর্বত্র কম সে কম চার-পাঁচতলা বাড়ি গিজগিজ করছে। মাথায় ভেঙে পড়লে রক্ষে থাকবে না! কোথাও একটা ফাঁকা মাঠ অবধি নেই!’’ সল্টলেকের বাসিন্দা কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায় রাত জেগে টিভি-তে পাঠানকোটের খবর দেখছিলেন। বললেন, ‘‘হঠাৎ দেখি সোফাটা নড়ছে। নিজের বাড়িটা হঠাৎ এ ভাবে চলতে শুরু করার অনুভূতিটা বেশ অস্বস্তির!’’
সোশ্যাল মিডিয়ার ‘ট্রেন্ডিং’য়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পাঠানকোটে জঙ্গি মোকাবিলাকে পিছনে ফেলে আগুয়ান মণিপুরের ভূমিকম্প। বছরের প্রথম কাজের দিনের সূচনাতেই এমন কাঁপুনিতে ফেসবুক-হোয়াট্সঅ্যাপে গুজগুজ শুরু হয়েছে বাঙালির। গোড়ার হতভম্ব ভাবটা কাটতে সাত সকালেই ‘কাঁপাকাঁপি সোমবার’কে স্বাগত জানিয়েছেন কেউ কেউ। তবে খুচরো ইয়ার্কি ছাপিয়ে বহুতলে কলকাতার রোজনামচায় এই চেনা ভয়টাও এখন জীবনের অঙ্গ। গড়িয়ার একটি আবাসনের ১৪তলার বাসিন্দা কাকলি বসুর কথায়, ‘‘আগে লোকে বড়জোর তিন-চারতলায় থাকত। এখন এত উঁচুতে বসবাসের সঙ্গী ভয়ও! ঘুমোতে যাওয়ার সময়ে প্রায়ই মনে হয়, রাতটা শান্তিতে কাটুক!’’ সঙ্গীতা যেমন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘নেপালের ভূমিকম্পের সময়ে আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে চার-পাঁচ মাস সময় লেগেছিল। এখনও সেই ভয়টা মাঝেমধ্যে তাড়া করে।’
ভূমিকম্পের এই আতঙ্কের পোশাকি নাম ‘সিসমোফোবিয়া’। মনস্তত্ত্ববিদ শিনা মিশ্র ঘোষের কথায়, ‘‘কোনও একটা অভিজ্ঞতার পরে ভয় বা মানসিক চাপ অস্বাভাবিক নয়! তবে তা কাটিয়ে ওঠার দাওয়াই খোঁজাও জরুরি।’’ অন্য যে কোনও আতঙ্কের মতো এ ক্ষেত্রেও গুমরে না বসে থেকে সকলের সঙ্গে কথা বলা দরকার। ভয় কাটাতে বা মনকে শান্ত করতে কিছু টোটকাও কার্যকর হয় বলে দাবি তাঁর।
কলকাতার বুকে ধাক্কার প্রতাপে কিন্তু গত বছরের নেপালকে ছাপিয়ে গিয়েছে এ বারের মণিপুরের বিপর্যয়। আইআইটি খড়্গপুরের বিশেষজ্ঞদের মতে, এ দিন কলকাতায় অনুভূত ভূমিকম্পের মাত্রা রিখটার স্কেলে পাঁচের কোঠায় ঢুকেছে। নেপালের বিপর্যয়ের সময়ে তা তিন মাত্রার উপরে ওঠেনি। এ যাত্রায় উৎসস্থলের বেশি কাছে থাকার দরুণ, ঝাঁকুনিটা আরও জোরালো ছিল।
আদতে উত্তর-পূর্ব ভারতের মেয়ে হওয়ার সুবাদে সল্টলেকের এ ই ব্লকের বাসিন্দা শ্রেয়সী সিংহও ভূমিকম্প কাকে বলে হাড়ে হাড়ে চেনেন। তিনিও কলকাতার অভিজ্ঞতাটুকু একেবারে ফেলনা বলছেন না। ঝটকায় ঘুম ভাঙতেই সঙ্গে সঙ্গে শিলচরে বোন সঙ্গীতা গুপ্তকে ফোন করে খবর নিয়েছেন তিনি। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভূমিকম্পের মাত্রা নেপাল বা মণিপুরের সমান হলে এ শহরে বিপর্যয়ের বহর আরও ব্যাপক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে পুরনো কলকাতা বা শহরের নতুন বহুতলগুলিতে এ দিনের ভূমিকম্প যে সে ভাবে দাগ কাটতে পারেনি, এটাও শহরবাসীর জন্য সুখবর! এ কালের মজবুত বহুতল ভূমিকম্প প্রতিরোধের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয় বলেই দাবি নামী স্থপতিদের। গোলপার্কের মোড়ে তেমনই একটি নতুন বহুতলের ১৬ তলার বাসিন্দা মৌসুমী ঘোষ বলছিলেন, ‘‘ভূমিকম্পে দুলুনির সময়ে মনে পড়ছিল, বাঁশগাছও তো ঝড়ে জোরে দোলে, কিন্তু সচরাচর তা তো ভেঙে পড়ে না।’’
শীতের রাতে এত ঝাঁকুনিতেও কারও কারও ঘুম ভাঙেনি। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের একটি আবাসনের ২৫ তলার প্রবীণ বাসিন্দা অসীম চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘অঘোরে ঘুমোচ্ছিলাম! পরে এক বন্ধু উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন করায় তো আমরা অবাক!’’
সোশ্যাল মিডিয়ায় মালুম হচ্ছে, ভূমিকম্পের সুবাদে কলকাতার বাঙালিদের এখন দু’টিই মাত্র গোত্র। যাঁরা ভূমিকম্প টের পেয়েছিলেন এবং যাঁরা তা পাননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy