Advertisement
০৫ মে ২০২৪

অবসাদ, না কি আত্মগ্লানি, প্রশ্নে পার্থর আত্মহত্যা

দিনে একটা করে ট্যাবলেট আর মাস তিনেক অন্তর এক বার করে আউটডোরে দেখিয়ে যাওয়া— এর বাইরে তাঁর আর কোনও চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। ২০১৫ সালের পয়লা অক্টোবর যখন পার্থ দে পাভলভ মানসিক হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন, তখন এটাই ছিল ডাক্তারদের পরামর্শ।

পার্থ দে

পার্থ দে

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:১৪
Share: Save:

দিনে একটা করে ট্যাবলেট আর মাস তিনেক অন্তর এক বার করে আউটডোরে দেখিয়ে যাওয়া— এর বাইরে তাঁর আর কোনও চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। ২০১৫ সালের পয়লা অক্টোবর যখন পার্থ দে পাভলভ মানসিক হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন, তখন এটাই ছিল ডাক্তারদের পরামর্শ। আর ছুটি পাওয়ার কথা জেনে পার্থর নিজের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘বাকি জীবনটা অর্থবহ কিছু কাজ করে যেতে হবে।’’ এ-ও বলেছিলেন, ‘‘চিকিৎসাটা যে জরুরি, সেটা মাঝখানের এই সময়টায় বুঝতে পেরেছি। আর ভুল হবে না।’’

সেই পার্থ দে মঙ্গলবার আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ায় খানিকটা বিভ্রান্ত চিকিৎসক এবং সমাজকর্মীরা। তাঁদের বক্তব্য, গায়ে আগুন ধরিয়ে কেউ যদি আত্মহত্যার কথা ভাবেন, তা হলে সেটা কোনও হঠকারী সিদ্ধান্ত নয়। আগাম চিন্তাভাবনা করেই ঠিক করা। ভেবেচিন্তে কেন এই সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি? গভীর অবসাদ বা একাকিত্ব থেকে? নাকি সমাজের প্রতি কোনও অভিমান, প্রতিবাদ বা আত্মগ্লানি পরোক্ষ ভাবে কাজ করেছে এ ক্ষেত্রে?

পাভলভের চিকিৎসকেরা বলছেন, পার্থ স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় ভুগছিলেন। সাধারণ ভাবে স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগীদের অন্তত ১০ শতাংশের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে। ওঁর ক্ষেত্রেও হয়তো তা-ই হয়েছে। তাঁরা অনেকে এ-ও মনে করছেন যে, পার্থবাবু হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময়ে যা-ই বলে থাকুন, হয়তো ফলো-আপ চিকিৎসাটা ঠিক মতো করাননি। নিয়মিত ওষুধও খাননি। তাই মানসিক সমস্যা আরও শিকড় ছড়াতে পেরেছিল তাঁর মধ্যে।

আরও পড়ুন: বাথরুমে পুড়ে মরলেন কঙ্কাল কাণ্ডের পার্থ

শুধু তা-ই নয়, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে পরপর তাঁর পোস্টগুলি দেখেও তাঁর মানসিক অস্থিরতার কথা বোঝা যায়নি। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে নিজের ছবি পোস্ট করেছিলেন পার্থ। ১৬ ফেব্রুয়ারি ব্যবহার করেছিলেন একটি উদ্ধৃতি, ‘ইট ইজ বেটার টু লাইট আ ক্যান্ডল, দ্যান কার্স দ্য ডার্কনেস’। অর্থাৎ, অন্ধকারকে অভিশাপ দেওয়ার চেয়ে আলো জ্বালানোর কাজটাই জরুরি।

২০১৫ সালের ১০ জুন পার্থকে শেক্সপিয়র সরণি থানার পুলিশ পাভলভে ভর্তি করায়। সেই থেকে ওই বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সেখানে ভর্তিন ছিলেন তিনি। পরে মিশনারিজ অব চ্যারিটির পক্ষ থেকে পার্থের দেখভালের দায়িত্ব নেওয়া হয়। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে তারাই পার্থকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি হোমে রাখে। গত বছরের মার্চ থেকে ওয়াটগঞ্জের ওই আবাসনে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে সেই সংস্থাটি।

মনোবিদ অনিরুদ্ধ দেব মনে করেন, পার্থবাবুর অসুখটা কোন পর্যায়ে ছিল, তা না জানলে আত্মহত্যার কারণ খুঁজে বার করা কঠিন। কারণ, এ সব ক্ষেত্রে মানসিক অবস্থা দ্রুত বদলে যেতে পারে। তবে সব আত্মহত্যার মূলেই যে অবসাদ থাকতে হবে, তা জরুরি নয়। তিনি বলেন, ‘‘চিকিৎসার পরে স্কিৎজোফ্রেনিয়ার রোগীর ধোঁয়াশাটা যখন কেটে যায়, তখন তিনি কী হারিয়েছেন, তা বুঝতে পারেন। সেটাই তাঁর মনে নিজের জীবনকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছা জাগিয়ে তুলতে পারে।’’

অনেকটা একই কথা বলেছেন মনোবিদ জয়রঞ্জন রাম-ও। তাঁর মতে, অসুস্থ থাকাকালীন এক জন মানুষ নানা ভাবে বিভ্রান্ত থাকেন। চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে গেলে বিভ্রান্তি কেটে স্বচ্ছতা আসে। তখনই তিনি বুঝতে পারেন, কী কী ভুল করেছেন, কী কী হারিয়েছেন সেই ভুলের জন্য। হয়তো সেই স্বচ্ছতাই মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে।

কিন্তু কতটা স্বচ্ছ হয়েছিল পার্থ দে-র চিন্তাভাবনার জগৎ, তা নিশ্চিত করে কে বলতে পারবেন? পাভলভে থাকাকালীন তাঁকে কেউ দেখতে আসতেন না, সেই আক্ষেপ ছিল পার্থর মনে। মাদার হাউস থেকে বেরোনোর পরেও একাকিত্বই ছিল তাঁর সঙ্গী। সেই একাকিত্বের মধ্যেই কি নিজের জীবনের শূন্যতার দিকগুলো আরও স্পষ্ট হয়েছিল তাঁর মনে? আঁকড়ে ধরতে চাইছিলেন কিছু সম্পর্ককে? গত পুজোয় পাভলভ হাসপাতালের সুপারের কাছে তিন হাজার টাকা পাঠিয়েছিলেন পার্থ। পুলিশ সূত্রের খবর, ওই মানসিক হাসপাতালে থাকার সময়ে সেখানকার কয়েক জন আবাসিকের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল পার্থর। তাঁদের পুজোয় নতুন জামা কিনে দেওয়ার জন্যই ওই টাকা পাঠিয়েছিলেন তিনি।

মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের কর্ণধার, সমাজকর্মী রত্নাবলী রায় মনে করেন, মানসিক অবসাদে পার্থবাবু আত্মহত্যা করেছেন, এটা ধরে নেওয়া অতিসরলীকরণ ছাড়া কিছুই নয়। তিনি বলেন, ‘‘সামাজিক ভাবে পার্থবাবু কেমন ছিলেন, তা কি কেউ জানেন? তাঁকে নিশ্চিত জীবন দেওয়া, সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল। রাষ্ট্র কি সেটা করেছে? পার্থবাবুর এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ ছিল কি না, তা-ই বা কে বলতে পারে? তিনি তো আচমকা আত্মহত্যা করেননি। যে ভাবে তিনি আত্মহত্যার সরঞ্জাম মজুত করেছিলেন, তাতে মনে হয়, এর পিছনে নির্দিষ্ট ভাবনা ছিল।’’

দিন কয়েক আগেই সু্প্রিম কোর্ট জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য-নীতি তৈরির ব্যাপারে কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের বক্তব্য, যাঁরা মানসিক রোগে ভুগছেন, তাঁদের জন্য তো বটেই, এমনকী, যাঁরা চিকিৎসা করিয়ে মানসিক হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাচ্ছেন, তাঁদের জন্যও অভিন্ন জাতীয় নীতি তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘কমিউনিটি কেয়ার’ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে। ‘কমিউনিটি কেয়ার’-এর মূল কথাই হল, এক জন রোগীকে পারিপার্শ্বিক সমাজের ঘিরে থাকা। তিনি যে সমাজবিচ্ছিন্ন জীব নন, সেই আশ্বাসটা জাগিয়ে তোলা। পার্থবাবুর ক্ষেত্রে তাঁর সহ-আবাসিকেরা জানিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগই ছিল না। লিফ্‌টে যাতায়াতের পথে কয়েক বার দেখা হয়েছে। ওই পর্যন্তই। পার্থর বর্তমান জীবনযাপন সম্পর্কে তাঁরা অন্ধকারেই ছিলেন।

জয়রঞ্জন রামের কথায়, ‘‘এক জন মনোরোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে পাঁচ খেকে ১০ শতাংশ ভূমিকা থাকে ওষুধের। তার পরের পর্যায়ে কিন্তু ‘কমিউনিটি কেয়ার’ খুব জরুরি। পার্থবাবুর মৃত্যু কমিউনিটি কেয়ারের ব্যর্থতাটাই প্রমাণ করে দিল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE