Advertisement
E-Paper

ফুটবলের টানে কাছাকাছি পাড়া-পরিবার

মেসিদের হারের পরে সম্পূর্ণার অবশ্য বিশ্বকাপ নিয়ে আগ্রহ শূন্য। মাঝরাত্তিরের পরে দু’চোখ খোলাও রাখতে পারেন না তিনি।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৮ ০২:৩০
হুল্লোড়: ফুটবল বিশ্বকাপের রঙে সেজেছে শোভাবাজারের গলি। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

হুল্লোড়: ফুটবল বিশ্বকাপের রঙে সেজেছে শোভাবাজারের গলি। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

শেষ কবে মায়ের পাশটিতে ছেলে এত ক্ষণ বসেছে, মনেই করতে পারেন না প্রৌঢ়া।

গড়িয়ার সম্পূর্ণা বসুর ছেলে-বৌমা দিনরাত স্মার্টফোনে বুঁদ। সদা ব্যস্ত দম্পতির ঘরের টিভি কয়েক বছর কার্যত ব্রাত্য। তবে তিন কামরার ফ্ল্যাটে মেগা সিরিয়াল রসিক সম্পূর্ণার ঘরেই টিকে আছে বড়সড় বোকাবাক্স। তা ছেলে-বৌমা বলল, ফোনে বা ল্যাপটপে খেলা দেখা গেলেও বিশ্বকাপ ফুটবল বলে কথা! মায়ের ঘরের এলইডি টিভিতেই দেখা যাক!

মেসিদের হারের পরে সম্পূর্ণার অবশ্য বিশ্বকাপ নিয়ে আগ্রহ শূন্য। মাঝরাত্তিরের পরে দু’চোখ খোলাও রাখতে পারেন না তিনি। তবু ছেলে-বৌমা ঘরে বসে খেলা দেখছে, দেখতে দেখতে ব়ড় শান্তিতে ঘুমোন সম্পূর্ণা। ছেলে কৌশিক কখনও মায়ের ঘুম ভাঙান, ক্রোয়েশিয়া কী দারুণ খেলছে, একটু দেখবে না মা! স্মার্টফোনে মুখ গোঁজা গেরস্থালির রোজনামচায় বহু যুগ আগের পারিবারিক গুষ্টিসুখ ছুঁয়ে যায় ষাটোর্ধ্ব নিঃসঙ্গ নারীকে। রুশ দেশের ফুটবল যুদ্ধে বড়সড় রথী-মহারথীদের হারের শোক শুধু নয়, পারিবারিক মিলনমেলার হাট ভাঙার অনিবার্যতাও সম্পূর্ণার গলার কাছে ব্যথার মতো দলা পাকিয়ে থাকে।

চার বছরে এক বার বিশ্বকাপ পুরনো পাড়ায় শিকড়ের টান হয়ে আসে রেলকর্মী অজয় করের কাছে। বৈষ্ণবঘাটায় বাড়ি করে চলে গিয়েছেন দেড় যুগ হল। তবু বিশ্বকাপ মানেই ছোটবেলার গন্ধমাখা হরিশ মুখার্জি রোড। বলরাম বসু ঘাট রোড ও অধুনা মুখ্যমন্ত্রীর গলি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের মোড়ে মাসভর জায়ান্টস্ক্রিনে মেসি-এমবাপে-নেমার-লুকাকুদের দাপাদাপি। রাতটা বৈষ্ণবঘাটায় না ফিরে পুরনো পাড়ায় ‘মেজদি’র বাড়িতেই থেকে যান ৫২ বছরের অজয়বাবু। তাঁর অভিন্নহৃদয় বন্ধু পাপ্পু দাস বা অনুজপ্রতিম শুভদীপ চট্টোপাধ্যায় ওরফে পকাইরাও বাঁশদ্রোণীর ফ্ল্যাট ছেড়ে রাতভর বিশ্বকাপের আমেজে মেতে পুরনো পাড়াতেই পড়ে থাকেন।

ব্রাজ়িল বা আর্জেন্টিনার অকাল বিদায়ের অভিঘাতে ধাক্কা খেলেও বাঙালির বিশ্বকাপ অনেকের কাছেই এক ধরনের অতীতের উদ্‌যাপন হয়ে ধরা দেয়। সেই ’৮৬-তে মারাদোনার শৌর্যমাখা উজ্জ্বল দিনগুলোয় পাড়ায় সবার বাড়িতে টিভি ছিল না। কখনও বা নানা কসরত করে বাংলাদেশের চ্যানেল ধরে খেলা দেখতে হত। তখন এক সঙ্গে অনেকে জড়ো হয়ে খেলা দেখার একটা বাধ্যবাধকতা ছিল। সেই সাবেক অভ্যাসটাই বিশ্বকাপে ফিরে ফিরে আসে! লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের এক অফিসার বিশ্বকাপ এলেই রসিকতা করেন, ‘‘পুলিশের আর চিন্তা নেই, লোকে খেলার টানে একসঙ্গে জেগেই রাত পাহারা দেবে।’’ কারও কারও অবশ্য পাল্টা মত, রাত জেগে এককাট্টা হয়ে খেলা দেখার ফাঁকেই চোরেদের সুবিধা। কখন আলমারি ফাঁকা করে তারা গোল দিল, গৃহস্থ টেরই পাবেন না।

বিশ্বকাপের মরসুমে পারিবারিক বা পাড়াতুতো আড্ডাটা যে আর একটু গাঢ় হয়, তা অবশ্য অনেকেই স্বীকার করেন। প্রিয় দল বা খেলোয়াড়কে নিয়ে হাসি-মস্করা লেগেই আছে। কুমোরটুলি পার্কে পঙ্কজ রায়দের বাড়ির সামনের রাস্তায় পর্দা টাঙিয়ে মাসভর নরক গুলজার। কংগ্রেস-তৃণমূল পার্টি অফিসের অষ্টপ্রহরের বাসিন্দা ‘তপাদা’, ঘটিবাবু বা চিন্টুদার মতো বুজ়ুর্গদের আড্ডা তো ম্যাচ শেষে ভোরের দিকেও ফুরোতে চায় না। পরের প্রজন্ম তিরিশের যুবা সুমন নায়েকরাও পাড়ার দাদা-কাকাদের ধাত পেয়েছেন। গোঁড়া ব্রাজিল-ভক্ত সুমন বললেন, ‘‘বিশ্বকাপে পাড়া ছেড়ে থাকব ভাবতেই পারি না!’’

তবে বিশ্বকাপ ঘিরে এই সামাজিকতা বা পারিবারিকতায় সকলেই যে মাহাত্ম্য খুঁজে পাচ্ছেন, তা নয়। ফুটবল-রসিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বিশ্বকাপে শুধু খেলার প্রতিই একনিষ্ঠ। তাঁর কথায়, ‘‘বিশ্বকাপের ম্যাজিকে আচমকা সবাই সবার কাছাকাছি চলে এল, তা কিন্তু নয়। পারস্পরিক সম্পর্কের রসায়নটাই আসলে শেষ কথা বলে।’’

Socialisation FIFA World Cup 2018 Family Bonding
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy