শোকাহত: কলকাতার সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাবের ক্যান্টিনে বালসুব্রহ্মনিয়ন ও রাজেশ্বরী। ছবি:দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
বিনা মেঘে বজ্রপাত না হোক, মহীরুহের পতন তো বটেই!
করুণানিধির মৃত্যুকে এ ভাবেই দেখছেন কলকাতার তামিলভাষীরা। বছর দেড়েক আগে জয়ললিতার আকস্মিক মৃত্যুতে ‘যমরাজের নিষ্ঠুর খেয়াল’ দেখেছিলেন তাঁরা। অভাবনীয় বা ‘এনেক্কেভে ইল্লে’ বলতে বলতে হিন্দুস্থান পার্কের সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাবে কান্নায় ভেঙে পড়েন প্রৌঢ়া থেকে তরুণীর দল। আর বুধবার সকালে থমথমে মুখে দেশপ্রিয় পার্কের ‘ভারতী তামিলসঙ্গম’ থেকে বেরোলেন সভাপতি তথা শিক্ষাবিদ জি ভি সুব্রহ্মনিয়ন। প্রিয় নেতা তথা তালাইয়ার জন্য সংক্ষিপ্ত শোকসভা সেরে অস্ফূটে ‘আলামারাম ভেরুডাম সাইনধাদু’ বা ‘বটবৃক্ষের পতন’ বলতে বলতে গাড়িতে উঠলেন তিনি।
দুপুরে নিজাম প্যালেসের ১৮ তলার সরকারি অফিস জুড়েও সেই মহীরুহের ছায়া। ল্যাপটপ থেকে চোখ সরাতে পারছেন না রাজায়োকিয়াম নক্কিরার। তামিল চ্যানেলে মেরিনা সৈকতের অন্ত্যেষ্টি-দৃশ্য। রেজিস্ট্রার জেনারেলের অফিসের ভাষা বিভাগের আধিকারিক নক্কিরার ছলছলে চোখে বলছেন, ‘‘এটাই তামিলনাডু! ৯৫ বছরের পরিপূর্ণ জীবন শেষেও প্রিয় নেতার
টানে কী উন্মাদনা!’’ দীর্ঘ রোগভোগের শিকার প্রবীণ নেতার দেহের সামনেও যে তামিলনাডু ‘উঠে বসো’ বা ‘এড়ুডু ভা তলাইভা’ বলে আকুল হয়ে
কাঁদতে পারে!
আড়াই দশকের কলকাতাবাসী তথা বাংলা-তামিল অভিধানকার নক্কিরারের মনে পড়ছিল জ্যোতি বসুর শোকযাত্রার কথাও। কিন্তু শোকার্তদের পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা তখনও ঘটেনি। বলতে বলতেই নক্কিরার মুখর তামিল কুলপতি করুণানিধির জ্যোতি বসুপ্রীতি নিয়ে। ২০০৯ সালে চেন্নাইয়ে বার কয়েক করুণানিধির বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। কলকাতার লোককে পেয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধি তখন জ্যোতি বসুর সঙ্গে সরস আড্ডার স্মৃতি মেলে ধরেন। ডিএমকে প্রধান তামিলনা়ড়ু থেকে হাতে-টানা রিকশা নিষিদ্ধ করার কথা বলতেই জ্যোতিবাবু নাকি বলেন, কলকাতায় তুলে দেওয়ার দরকার নেই। রিকশাওয়ালারা আস্তে আস্তে অন্য চাকরিতে ঢুকলে রিকশা এমনিই উঠে যাবে!
গত শতকের তামিল দ্রাবিড় রাজনীতির অন্যতম প্রাণপুরুষ করুণানিধিকে এখন নিছকই রাজনীতির মানুষ বলে দেখতে রাজি নন কলকাতার তামিল ব্রাহ্মণরাও। তাঁকে নিয়ে দুর্নীতি-বিতর্কও আবেগে ঢাকা পড়ছে। একটি চা সংস্থার আধিকারিক জয়রামন থেকে সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাবের ক্যান্টিনের কর্তা দম্পতি বালসুব্রহ্মনিয়ন-রাজেশ্বরীরা একমত, ‘‘চিত্রনাট্যকার-লেখক-কবি করুণানিধি সব তামিলভাষীর হৃদয়ে।’’ তামিল সংস্কৃতিচর্চার বিশিষ্ট সর্বভারতীয় সংগঠন ভারতী তামিলসঙ্গমের কলকাতা শাখা প্রতি বছরই তামিল ভুবনের এক জন কৃতী সন্তানকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০০৯ সালে করুণানিধিকেই ‘তামিল তলাই মহান’ বা সেরা তামিল সন্তান’ স্মারক দেন তাঁরা। সেই সূত্রেই কলকাতাবাসী তামিলভাষীরা অনেকেই চেন্নাইয়ে করুণানিধির সংস্পর্শে এসেছিলেন।
নিজেকে বেশি বাঙালি বললেও কলাইনার বা শিল্পী করুণানিধিকে নিয়ে আবেগ এড়াতে পারছেন না চিত্র পরিচালক অশোক বিশ্বনাথনও। মণিরত্নমের ‘ইরুভার’ ছবিতে উঠে আসা করুণানিধি-এমজিআর সম্পর্কের টানাপড়েনের কাহিনি বড্ড প্রিয় তাঁর। রাজনীতির দর্শন ও সিনেমার কাহিনিকে করুণানিধির মতো কম জনই মেলাতে পেরেছেন।
কলকাতার হাজার বিশেক তামিলভাষীর অনেকে উঁচু পদে কর্মরত। সাধারণত রাজনৈতিক আবেগ লুকিয়ে রাখতে তাঁরা অভ্যস্ত। বর্ণময় তামিল কুলপতি বা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব করুণানিধির মৃত্যু সেই মাপা আবেগও ওলটপালট করে দিয়ে গেল।
কলকাতার এই মুহূর্তের শিরোনাম কী - জানতে চোখ রাখুন আমাদের কলকাতা বিভাগে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy