Advertisement
০৫ মে ২০২৪

নিজে জয়ী, আত্মরক্ষার পাঠ দিচ্ছেন অন্যদের

কারও বয়স পাঁচ-ছয়। কারও তেইশ-চব্বিশ। কেউ সালোয়ার কামিজ পরে, কেউ আবার বোরখাও পরেছে তার উপরে। সামনে সাদা ক্যারাটের পোশাকে ছোটখাটো চেহারার এক মেয়ে। তিনি কখনও শক্ত মুঠি ছুড়ে দিচ্ছেন, কখনও সামনের জনের কাঁধ বরাবর পা তুলে দিচ্ছেন।

অপরাজিতা: ক্যারাটের তালিম দিচ্ছেন আয়েষা। ছবি: সুমন বল্লভ

অপরাজিতা: ক্যারাটের তালিম দিচ্ছেন আয়েষা। ছবি: সুমন বল্লভ

দীক্ষা ভুঁইয়া
শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৭ ০১:১২
Share: Save:

কারও বয়স পাঁচ-ছয়। কারও তেইশ-চব্বিশ। কেউ সালোয়ার কামিজ পরে, কেউ আবার বোরখাও পরেছে তার উপরে। সামনে সাদা ক্যারাটের পোশাকে ছোটখাটো চেহারার এক মেয়ে। তিনি কখনও শক্ত মুঠি ছুড়ে দিচ্ছেন, কখনও সামনের জনের কাঁধ বরাবর পা তুলে দিচ্ছেন। সঙ্গে মৌখিক নির্দেশ। এই কোচ, আয়েষা নূরকে দেখেই চলছে প্রশিক্ষণ। তিনি যে ভাবে হাত-পা চালাচ্ছেন, তা-ই করে দেখার চেষ্টা করছেন বাকিরা।

এণ্টালি থানার পদ্মপুকুর সংলগ্ন মফিদুল ইসলাম লেনের বাসিন্দা আয়েশা। ক্যারাটেতে ব্ল্যাকবেল্ট (দ্বিতীয় ডিগ্রি) জয়ী। ছোটবেলায় দাদাকে ক্যারাটে শিখতে দেখে কোচ এম এ আলির কাছে ভর্তি হন। প্রশিক্ষণ শেষে ঠিক করেন মেয়েদের আত্মরক্ষার পাঠ দেবেন। সেই মতো ২০১৩ থেকে শুরু করেন নিজের ক্যারাটে কোচিং।

আয়েশার কথায়, ‘নিজের রক্ষা নিজেকেই করতে হবে। কিন্তু মেয়েরা সেখানেই দুর্বল। প্রতিটি মেয়েকে ছোট থেকেই মার্শাল আর্ট শেখানো উচিত। বিশেষত আমার মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পড়াশোনার বাইরে কিছু শারীরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। অথচ দিন বদলেছে। আর তাই মনে হয়েছিল অন্যদের সঙ্গে আমার সম্প্রদায়ের মেয়েদের বেশি করে ক্যারাটে শিখতে আসা উচিত।’’ চার বছর আগে শুরু করা কাজে তিনি অনেকটাই এগিয়েছেন। বর্তমানে তাঁর ছাত্রীর সংখ্যা কয়েকশোর উপরে। প্রতি বৃহস্পতিবার সিআইটি রোডে রামলীলা ময়দানের কোচিংয়ে তাঁদের দেখা মেলে। কাউকে নিয়ে আসেন মায়েরা। আবার কেউ নিজেরাই স্কুল বা কলেজ থেকে হাজির হন মাঠে। ‘ওর্য়ামআপ’-এর পরেই শুরু হয় ক্যারাটের নানা কসরত। কখনও প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে
‘পাঞ্চ’ ছোড়া, কখনও প্রতিপক্ষের ঘুষি এড়িয়ে আক্রমণ। সেই ছাত্রীদেরই এক জন মসরুর বানো। তালতলার বাসিন্দা মসরুর তিন বছর ধরে ক্যারাটে শিখছে। দু’টি ধাপ পেরিয়ে গিয়েছে সে। পদ্মপুকুরের রেশমা বেগম প্রতি সপ্তাহে নিজের বছর ১৩-র মেয়েকে নিয়ে আসেন। তাঁর কথায়, ‘‘এখন শুধু পড়াশোনা নয়, নিজেদের রক্ষাও নিজেদেরই করতে হবে।’’

আয়েশার এই কাজ শুরু করাটা খুব একটা সহজ ছিল না। কারণ পদ্মপুকুর সংলগ্ন যে এলাকাতে তাঁর বাড়ি, সেখানে মেয়েরা বড়জোড় স্কুল পর্যন্ত গেলেও, ক্যারাটে শেখার কথা ভাবতেই পারে না। আয়েশার ক্ষেত্রে বাড়ি থেকে বাধা না এলেও, পড়শিদের কথা শুনতে হয়েছে তাঁর মাকে। বিশেষত বাবার মৃত্যুর পরে তাঁকে শুনতে হতো, ‘‘ছেলে শিখছে শিখুক, মেয়েকে কেন শেখাচ্ছো?’’ আয়েশার মা শাকিলা বেগম বুঝেছিলেন মেয়েকে তৈরি করতে গেলে পড়াশোনার পাশাপাশি আত্মরক্ষাও শিখতে হবে।

কিন্তু বাড়ির সমর্থনের পরেও বাধ সেধেছিল আয়েশার শরীর। কারণ তাঁর মৃগী রয়েছে। যখন-তখন ‘অ্যাটাক’ হলে দাঁতে দাঁত লেগে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। কখনও পরপর অ্যাটাকে শরীর দুর্বল হয়ে গেলে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ভাল থাকতে গেলে তাই আয়েশাকে প্রতিদিন ছ’-সাত ঘণ্টা ঘুমোতেই হয় আর সঙ্গে পুষ্টিকর খাবার ছাড়াও প্রয়োজন পড়ে দু’হাজার মিলিগ্রাম করে নার্ভের ওষুধ। তাতেও হাল ছাড়েননি তিনি। এক সময়ে খাবার জুটত না, ওষুধ তো দূর অস্ত্‌। কিন্তু এখানেও হাজির ছিলেন তাঁর কোচ। নানা জায়গা থেকে সাহায্য নিয়ে তাঁকে ক্যারাটে শিখিয়ে গিয়েছেন আর আজ সেই ছাত্রীই পাঠ দিচ্ছেন শহরের মেয়েদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE