Advertisement
E-Paper

হয়েছে উন্নয়ন, বদলায়নি শুধু জল-ছবিটা

সকলে যেখানে মিলেমিশে থাকেন, সেটাই হল পাড়া। যেখানে জীবনযাপনে নেই কোনও ভেদাভেদ, উপেক্ষা কিংবা তাচ্ছিল্য। কারও কোনও ঘাটতি থাকলে সেটাকে পূরণ করেন বাকিরা। আমার পাড়া খিদিরপুরের রমানাথ পাল রোড।

দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ০১:১৫
শুভাশিস ভট্টাচার্য

শুভাশিস ভট্টাচার্য

সকলে যেখানে মিলেমিশে থাকেন, সেটাই হল পাড়া। যেখানে জীবনযাপনে নেই কোনও ভেদাভেদ, উপেক্ষা কিংবা তাচ্ছিল্য। কারও কোনও ঘাটতি থাকলে সেটাকে পূরণ করেন বাকিরা। আমার পাড়া খিদিরপুরের রমানাথ পাল রোড। সেই ১৯৪৫ থেকে এ পাড়ায় আমার বসবাস। সেই তখন থেকে আজ পর্যন্ত এসেছে নানা ধরনের পরিবর্তন। তবু বদলায়নি এ পাড়ার স্বতন্ত্র চরিত্র। এখনও রয়েছে সকলের মধ্যে মিলমিশ। এ পা়ড়ায় কখনও একলা বোধ করি না।

কার্লমাক্স সরণি থেকে শুরু হয়ে পাড়াটা মিশেছে হেমচন্দ্র স্ট্রিটে। তার এক দিকে রামকমল স্ট্রিট, অন্য দিকে গোপাল ডাক্তার রোড। অতীতে এই অঞ্চলের নাম ছিল বেড়াপুকুর। কাছাকাছি রয়েছে পীতাম্বর সরকার লেন। আমার জীবন-স্মৃতির অভিজ্ঞতায় দেখেছি প্রত্যেকের মানসিকতা কিংবা চিন্তাধারার উপরে গভীর প্রভাব ফেলে পাড়া। আমার নিজের জীবনে সেই প্রভাবটা আজও অক্ষুণ্ণ।

আজকের পাড়াটা পরিচ্ছন্ন। নিয়মিত রাস্তা পরিষ্কার এবং জঞ্জাল সাফাই হওয়ায় এখন আর যত্রতত্র জঞ্জাল পড়ে থাকে না। আগে পাড়ার কাছে একটি বড় ভ্যাট থাকায় দুর্গন্ধ ছড়াত। এখন সেই সমস্যা আর নেই। তবে কিছু মানুষের মধ্যে এখনও নাগরিক সচেতনতার অভাব থাকায় এক-এক সময়ে প্লাস্টিক বন্দি আবর্জনা আছড়ে পড়ে রাস্তার মাঝখানে। আলোকস্তম্ভের জোরালো আলোয় রাতেও পাড়াটা আলো ঝলমলে। এলাকার উন্নয়নে কাউন্সিলর ষষ্ঠী দাস সদা তৎপর। কোনও সমস্যার কথা জানালে তিনি সাধ্যমতো সমাধানের চেষ্টা করেন। কাছেই পদ্মপুকুর। সেখানে রয়েছে একটি সুসজ্জিত পার্ক। এলাকার মানুষ সকাল-সন্ধ্যায় সেখানে বেড়াতে যান।

শুধু বদলায়নি একটি ছবি! মাঝেমাঝে মজা করেই বলি, আমাদের পাড়াটা ‘লিটল ভেনিস’। একটু বৃষ্টিতে আজও জল জমে যায়। তাই গ্রীষ্মের দাবদাহেও পাড়ার সকলে ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’-র পরিবর্তে ‘আয় বৃষ্টি কেঁপে’ বলি। কারণ জমা জল পাড়ার বেশির ভাগ বাড়ির একতলায় ঢুকে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত করে। বর্ষা এলেই আসবাব থেকে প্রয়োজনীয় সব জিনিস দোতলায় তুলতে হয়। আর যাঁরা এক তলায় থাকেন, তাঁদের অবস্থা হয় শোচনীয়। জানি না এ সমস্যার সমাধান কবে হবে। এ পাড়ার আর এক সমস্যা গাড়ি রাখার ব্যবস্থা। পাড়ার একাংশ একটি ট্রাভেল এজেন্সির পার্কিং প্লেসে পরিণত হয়েছে। যার দরুণ পাড়া-পড়শির অনেকেরই নিজেদের গাড়ি রাখতে সমস্যা হয়।

এ পাড়ায় কিছু কিছু পুরনো বাড়ি ভেঙে তৈরি হয়েছে বহুতল। আজকের পাড়ায় মিশ্র এক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। এসেছে বহু অবাঙালি পরিবার। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলেও কমেছে তাঁদের বাড়িতে যাতায়াত। এখন শুধু উৎসব-অনুষ্ঠানেই যাতায়াত হয়। আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেকেই আর নেই। কেউ প্রয়াত হয়েছেন, কেউ বা পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন। অবসরে তাঁদের অভাবটা আজও অনুভব করি।

এই অঞ্চলে নানা ধর্মের মানুষ থাকেন। তবু পাড়ার লোকেদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাতের মূল জায়গা এখানকার ৭৫ পল্লির দুর্গাপুজো। এক-এক সময়ে মনে হয়, এই পুজোটাই আজও সকলকে একসঙ্গে ধরে রেখেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জড়িয়ে আছে পুজোর নানা কাজকর্মে। দেখে ভাল লাগে যুব সম্প্রদায়ের পাড়ার নানা ব্যাপারে উৎসাহ দেখে। যে কোনও সমস্যায় বা বিপদ-আপদে তাদেরও পাশে পাওয়া যায়। এ পাড়ায় কখনও লোকবলের অভাবে অসহায় বোধ করতে হয় না কাউকেই।

কাছেই খিদিরপুর একাডেমিতে আমার পাড়াশোনা। সেই স্কুলের দিনগুলি থেকেই একটু একটু করে গভীর ভাবে মিশে গিয়েছি এ পাড়ার আবহাওয়া, চরিত্র এবং ছন্দের সঙ্গে। এখানেই প্রথম খেলাধুলোয় হাতেখড়ি, সাইকেলে চড়া, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। মনে পড়ে যায়, রাত জেগে সরস্বতী পুজোর মণ্ডপ তৈরি কিংবা পুজোর খুঁটিনাটির ব্যবস্থা করা। আগে পাড়ায় গানের জলসা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলেও সে সব কবেই স্মৃতির খাতায় নাম লিখিয়েছে। সময়ের সঙ্গে এ রকম কিছু পরিবর্তন এসেছে ঠিকই, তবু কোথায় যেন রয়েছে শিকড়ের টান। অন্য কোথাও গিয়ে হয়তো মানিয়েই নিতে পারব না। তাই কখনও এ পাড়া ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। এখানেই যে পেয়েছি জীবনের সব কিছু।

লেখক শিশু চিকিৎসক

Alley Development
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy