Advertisement
E-Paper

সারদার ভূত, বিজেপির তাড়ায় ছুটছে শাসক দল

অতৃপ্ত আত্মা আছে একাধিক! কিন্তু তারা প্রতিশোধ নেবে কি? অন্য ভূত যে ঘাড়ের উপরে চেপে বসেছে! শিখা মিত্র দান ছেড়ে দেবেন, অনেক দিন ধরেই ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। ঝোপ বুঝে কোপ মারবেন ভেবে ঘুঁটি সাজাচ্ছিলেন শঙ্কুদেব পণ্ডা। শাসক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের হাত মাথার উপরে ছিল। তৃণমূলের ছাত্র নেতা ভাবছিলেন, চৌরঙ্গি থেকেই বুক ফুলিয়ে সোজা বিধানসভায় পদার্পণ ঘটাবেন! কিন্তু সংসার-ধর্ম থেকে বেরিয়ে টিকিট নিয়ে চলে গেলেন নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়। ছাত্র সংগঠনের নানা কাজে বিব্রত তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে মুকুলও রক্ষা করতে পারলেন না ছাত্র নেতার স্বপ্ন!

রোশনী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৫০

অতৃপ্ত আত্মা আছে একাধিক! কিন্তু তারা প্রতিশোধ নেবে কি? অন্য ভূত যে ঘাড়ের উপরে চেপে বসেছে!

শিখা মিত্র দান ছেড়ে দেবেন, অনেক দিন ধরেই ক্ষেত্র প্রস্তুত ছিল। ঝোপ বুঝে কোপ মারবেন ভেবে ঘুঁটি সাজাচ্ছিলেন শঙ্কুদেব পণ্ডা। শাসক দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের হাত মাথার উপরে ছিল। তৃণমূলের ছাত্র নেতা ভাবছিলেন, চৌরঙ্গি থেকেই বুক ফুলিয়ে সোজা বিধানসভায় পদার্পণ ঘটাবেন! কিন্তু সংসার-ধর্ম থেকে বেরিয়ে টিকিট নিয়ে চলে গেলেন নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়। ছাত্র সংগঠনের নানা কাজে বিব্রত তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে মুকুলও রক্ষা করতে পারলেন না ছাত্র নেতার স্বপ্ন!

নয়না প্রার্থী হলেন মানে উত্তর কলকাতার সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তালতলার বাড়িতে আবার একটা টিকিট ঢুকল। এ বার তা হলে এসপার-ওসপার! মনে মনে ভেবেছিলেন ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের দাপুটে তৃণমূল কাউন্সিলর ইকবাল আহমেদ। সুদীপের সঙ্গে তাঁর ‘মধুর সম্পর্ক’ তৃণমূলের অন্দরে সুবিদিত! চার মাস আগে লোকসভা নির্বাচনে চৌরঙ্গি বিধানসভা এলাকা থেকে উত্তর কলকাতার কংগ্রেস প্রার্থী সোমেন মিত্র যে দেড় হাজার ভোটের ‘লিড’ পেয়েছিলেন, তার নেপথ্যেও নাকি ইকবালেরই হাতযশ! এ বার তো তা হলে হাতের সুখ করে নেওয়ার আরও বড় মওকা! কিন্তু সে গুড়েও বালি! ছক অঙ্কুরেই বিনাশ করতে তৃণমূল ভবনে ইকবালকে ডেকে বসতে বাধ্য হলেন মুকুল-সুদীপ। চৌরঙ্গির বৈতরণী উতরে দেওয়ার ভার চাপল কি না বিধায়ক ইকবালেরই ঘাড়ে!

বিদ্রোহ করার স্বপ্নে আপাতত তাই তালাচাবি! কেন? সারদা এবং সিবিআইয়ের ভূত আছে যে! দলেরই নেতাদের উপরে ক্ষোভ ফলাতে গিয়ে সারদার ছায়ায় হেরে (যে কেন্দ্র আবার তৃণমূলেরই দখলে ছিল) বসা চলে নাকি? সারদা কাণ্ডের সিবিআই তদন্তে শাসক দলের একের পর চরিত্রকে নিয়ে যখন টানাটানি, তখন খাস কলকাতার বুকে এই শরতের অকাল ভোটে হেরে বসলে আর দেখতে হবে না! অগত্যা অনিচ্ছার ঢেঁকি গিলতে হয়েছে ইকবালদের। চৌরঙ্গির কয়েকটা বুথে তাঁর বাহিনী কী খেল দেখাবে, আতঙ্কে বিরোধীরা। কেন্দ্রীয় বাহিনীও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে।

ইকবাল অবশ্য এ সবই ‘বিরোধীদের গল্প’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁর পাল্টা দাবি, “বিজেপি উত্তরপ্রদেশ থেকে লোকজন আনতে পারে বলে খবর পেয়েছি। ওদের কেন্দ্রীয় নেতারা সেই রকমই ব্যবস্থা করবেন বলেছেন।” তৃণমূলের শীর্ষ নেতারাও বলছেন, স্বয়ং সভাপতি অমিত শাহকে এনে চৌরঙ্গিতে সভা করানোর পরে আসনটা হারলে বিজেপি বেইজ্জত হবে। তাই মুখতার আব্বাস নকভি থেকে সিদ্ধার্থনাথ সিংহ, বিজেপি-র সর্বভারতীয় নেতারা হইচই পাকাচ্ছেন।

লক্ষ্যণীয় লোকসভার ফলের নিরিখে চৌরঙ্গিতে অল্প ভোটে এগিয়ে কংগ্রেস। অথচ ইকবালদের নিশানায় বিজেপি! তাঁরা জানেন, সারদার বাজারে বিজেপি-র কাছে হারলে ডবল ধামাকা হবে! দলের সম্ভ্রম ধুলোয় লুটোবে। মধ্য কলকাতায় তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “লোকসভায় সোমেনদা প্রার্থী ছিলেন। ওঁর নিজস্ব ক্যারিশমা কিছু আছে এখনও। এ বার কংগ্রেসের প্রার্থী সন্তোষ পাঠক নিজের ওয়ার্ডেই বিজেপি-র কাছে পিছিয়ে!” মধ্য কলকাতায় কংগ্রেস ছেড়ে প্রদীপ ঘোষের মতো নেতার বিজেপি-তে যাওয়াও গেরুয়া শিবিরকে নিয়ে জোড়া ফুলের চিন্তা বাড়িয়েছে।

মুুকুলবাবু মনে করছেন, সারদা-বিজেপি নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তাঁর দাবি, “মানুষ জানেন, সিবিআইয়ের নিরপেক্ষতা প্রশ্নাতীত নয়। অনেক সময়েই তারা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে কাজ করে।” এই যুক্তিতেই মুকুলবাবুর সিদ্ধান্ত, “সারদা-কাণ্ডে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জড়িয়ে যা বলা হচ্ছে, সে সবই গুজব! মানুষ গুজবে কান দেবেন না। ভোটের ফলেই তা প্রমাণ হবে!”

চৌরঙ্গির তরুণ বিজেপি প্রার্থী রীতেশ তিওয়ারির দাবি, “মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরে ভোট চাওয়ার সময় দারুণ সাড়া পেয়েছি!” রীতেশকে বিধানসভায় পাঠানোর লক্ষ্যে এই কেন্দ্রে প্রচার করে গিয়েছেন স্বয়ং বিজেপি সভাপতি এবং তাঁরই পরামর্শে কলকাতার রাজপথে প্রথম বার স্লোগান উঠেছে, ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, মমতা ব্যানার্জি চোর হ্যায়’! রেল প্রতিমন্ত্রী মনোজ সিংহ থেকে তারকা-সাংসদ মনোজ তিওয়ারি সারদা-হাওয়ায় বলীয়ান বিজেপি নেতৃত্ব চৌরঙ্গি থেকেই রাজ্যে পরিবর্তনের পরিবর্তন শুরু করার ডাক দিয়েছেন তাঁরা।

সোমেন-জায়া শিখা তৃণমূলে বিদ্রোহ করে চৌরঙ্গির বিধায়ক-পদে ইস্তফা দিয়ে কংগ্রেসে গিয়েছেন। তাই ওই কেন্দ্রে উপনির্বাচন। এই ঘটনাকেও তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচারে হাতিয়ার করছেন রীতেশ। বলছেন, “তৃণমূলের দুষ্কর্ম সহ্য করতে না পেরেই শিখাদেবী বিদ্রোহী হয়েছিলেন। অর্থাৎ তৃণমূলই এই অকাল নির্বাচন চাপিয়ে দিল। মানুষ ভোটে এর জবাব দেবেন!”

বিজেপি-র এই বাড়তি উদ্দীপনা সামলে তৃণমূলকে হারিয়ে রাজ্যে ভাঙন-দুর্গত কংগ্রেসকে নতুন সঞ্জীবনী দেওয়ার গুরুদায়িত্ব অধীর চৌধুরী দিয়েছেন কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর সন্তোষকে। তাঁর দাবি, “লোকসভা ভোটের সময়কার মোদী-হাওয়া এখন নেই। লোকসভা ভোটের পরে বিভিন্ন রাজ্যের উপনির্বাচনে বিজেপি হারছে। আর এ রাজ্যে বিজেপি-কে নিয়ে বেশি ভাবার কারণ নেই।” কংগ্রেস নেতা তথা সন্তোষের নির্বাচনী এজেন্ট অমিতাভ চক্রবর্তীরও দাবি, “বিজেপি কোনও কাঁটা নয়! লড়াই হবে তৃণমূল আর কংগ্রেসের।”

লড়াইয়ে ঢুকতে চাইছেন সিপিএম প্রার্থী ফৈয়াজ আহমেদ খানও। কলকাতায় সিপিএম বহু দিন ধরেই দুর্বল। তার মধ্যে কয়েক মাস আগের লোকসভা ভোটে চৌরঙ্গি এলাকায় বামেরা চতুর্থ হয়েছে! বামেদের রক্তক্ষরণের এমন আবহেও আশাবাদী কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন মেয়র পারিষদ ফৈয়াজ। তাঁর যুক্তি, “প্রচারে ভাল সাড়া পাচ্ছি। আসলে দেশে বিজেপি এবং রাজ্যে তৃণমূলের প্রতি মানুষের মোহভঙ্গ হয়েছে। আর কংগ্রেসের দুর্নীতির কথা মানুষ ভোলেননি।” চৌরঙ্গি অবশ্য বরাবরই বাম-বিরোধী এলাকা বলে পরিচিত। তবু এখান থেকেই এক বার উপনির্বাচনে জিতেছিলেন ফ্রন্ট প্রার্থী, প্রয়াত অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়। তথ্যটুকু ফৈয়াজকে মনোবল দিচ্ছে।

তৃণমূল প্রার্থী নয়নাও অভিনেত্রী। আগেও বৌবাজার থেকে তৃণমূলের বিধায়ক হয়েছেন। মাঝে দলের সঙ্গে সম্পর্ক তামাদি হয়ে যাওয়ার পরে এখন আবার রাজনীতিকের ভূমিকায় তিনি প্রাণ ঢেলেই অভিনয় করছেন। আর পত্নী-প্রার্থীর পাশে আছেন লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা এবং স্থানীয় সাংসদ সুদীপবাবু। পতি-মাহাত্ম্যই চৌরঙ্গির লড়াইয়ে নয়নাকে কিছুটা এগিয়ে রাখছে। তবু তার মধ্যেই কাঁটা হয়ে থাকছে তাঁর দলবদলের ইতিহাস। ২০০৪ সালে মমতা সম্পর্কে যে সব বিস্ফোরক অভিযোগ তুলে নয়না তৃণমূল ছেড়েছিলেন, তার নথি জোগাড় করে প্রচার করছে কংগ্রেস এবং বিজেপি। নয়না অবশ্য সে সবে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাঁর পাল্টা কটাক্ষ, “যাদের কাছে কোনও বিষয় নেই, যারা প্রার্থী খুঁজে পায় না, তারা এ সব বলছে!” নয়নার দাবি, “আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নের দূত। দিদি মানুষের ভাল করছেন। তাই তাঁর প্রার্থী হিসাবে আমি জিতব!”

চৌরঙ্গি কেন্দ্রের মধ্যে প্রায় ৫৩ হাজার সংখ্যালঘু ভোটের দিকে তাকিয়ে সিপিএমের ফৈয়াজকে এগিয়ে দেওয়া, প্রায় ৫১ হাজার অ-বাংলাভাষী ভোটে ভাগ বসাতে রীতেশ-সন্তোষ লড়াই— বিরোধীদের মধ্যে এ সব ভাগাভাগির অঙ্কে স্বস্তি পেতে পারেন নয়না। তবু ঝুঁকি তো নেওয়া যায় না! তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “ইকবালকে বলেছি, ইজ্জত কা সওয়াল! উতরে দাও ভাই!”

chowringhee saradha case roshni mukhopadhyay by-election state news kolkata news latest news online latest news
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy