Advertisement
E-Paper

‘দালাল’ নয়, হয়ে উঠলেন রক্ষাকর্তা

তখন চারদিকে আতঙ্কের দৌড় শুরু হয়েছে। তার মধ্যেই প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছিলাম বছর তিরিশের ছেলেটির দিকে। কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই তাঁর কথা বলার সময় নেই তখন। তবু ট্রলিতে রোগী নিয়ে কার্ডিয়োলজি বিল্ডিংয়ের দিকে যেতে গিয়ে শুধু বললেন, ‘‘আমাদের নাম দালাল।’’

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৫৩
এক ট্রলিতে উদ্ধার অনেক রোগীকে। সোমবার, আগুন লাগার পরে এসএসকেএমে।

এক ট্রলিতে উদ্ধার অনেক রোগীকে। সোমবার, আগুন লাগার পরে এসএসকেএমে।

তখন চারদিকে আতঙ্কের দৌড় শুরু হয়েছে। তার মধ্যেই প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছিলাম বছর তিরিশের ছেলেটির দিকে। কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই তাঁর কথা বলার সময় নেই তখন। তবু ট্রলিতে রোগী নিয়ে কার্ডিয়োলজি বিল্ডিংয়ের দিকে যেতে গিয়ে শুধু বললেন, ‘‘আমাদের নাম দালাল।’’

এই ‘দালাল’দেরই সোমবার এসএসকেএম হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডে পরিত্রাতার ভূমিকায় দেখা গেল! হাসপাতালের রোনাল্ড রস বিল্ডিংয়ের প্রায় মাথা থেকে ধোঁয়া আর আগুনের ফুলকি দেখেই ওঁরা উদ্ধারকাজে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। বাড়িটির প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ থেকে অপারেশন থিয়েটার — একে-একে রোগীদের ট্রলিতে কিংবা পাঁজাকোলা করে উদ্ধার করে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন এসএসকেএমের এই কুখ্যাত ‘দালাল’রাই। এবং এ কথা একবাক্যে স্বীকারও করে নিয়েছেন হাসপাতালের প্রবীণ থেকে নবীন সব ডাক্তারই।

কিন্তু আপনারা তো মোটা অর্থের বিনিময়ে বেআইনি ভাবে ভর্তি থেকে অন্যান্য পরিষেবার ব্যবস্থা করে দেন? প্রশ্নটা করতেই এতটুকু বিচলিত না হয়ে এক জন বললেন, ‘‘তাতে কি! বিপদের দিনে ত্রাতার ভূমিকায় নেমে কেউই নিজেদের পরিচয় দিতে চান না।’’ তার পর কিছুটা কিছুটা অভিমানী গলায় বললেন, ‘‘আমাদের পরিচয় নিয়ে কী হবে! আমরা দালাল— এই পরিচয়ই ঠিক আছে।’’

শুধু অবশ্য ওঁরা নন, হাসপাতালের যে চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের বিরুদ্ধে আকছার দায়িত্বে ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে, নার্সদের বিরুদ্ধে রোগীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের — এ দিন তাঁদেরই একটা বড় অংশকে দেখা গেল ত্রাতার ভূমিকায়। রোগীদের শয্যা থেকে নামানো, হাত ধরে কিংবা পাঁজাকোলা করে বাইরে বার করা, ট্রলি ঠেলা সবই করেছেন নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে। অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এর এক তলায় পাশাপাশি যে দু’টি ঘরে উদ্ধার হওয়া প্লাস্টিক সার্জারি এবং লাইগেশন-এর রোগীদের অস্থায়ী ভাবে রাখা হয়েছে, সেখানেও নিরন্তর তদারকি চালিয়েছেন তাঁরাই।

এসএসকেএম-এর দালাল চক্র নিয়ে আকছার অভিযোগ উঠেছে। চতুর্থ শ্রেণি ও নার্সদের মধ্যে অনেকেই এই দালালচক্রের সঙ্গে যুক্ত বলে হাসপাতেল কান পাতলেই শোনা যায়। সম্প্রতি রাজ্যের পূর্ত, ক্রীড়া ও যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এসএসকেএম-এর রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান হওয়ার পরে দালালচক্র ভাঙতে কড়া অবস্থান নিয়েছেন। পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছেন একাধিক সন্দেহভাজন দালাল। এমনকী, ওই মামলায় পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির তৃণমূল ইউনিয়নের নেতা রাজেন মল্লিককেও। এসএসকেএমের এক প্রবীণ চিকিৎসকের কথায়, ‘‘ওই রাজেনের দলবলই কিন্তু আজ প্রথম থেকে আগুনের ময়দান দাপিয়ে বেড়াল। দমকল আসার অনেক আগেই ওরা সিংহভাগ রোগীকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে।’’

তখন দুপুর ১টা বেজে গিয়েছে। সকাল থেকে বিশৃঙ্খলার জেরে রোগীদের খাবার এসে পৌঁছয়নি। এক নার্স তড়িঘড়ি কয়েক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে এলেন। আনলেন কয়েক বোতল জলও। বললেন, ‘‘যতক্ষণ ভাত না আসছে, এটুকুই খাওয়াই। একেই অসু্স্থ লোকজন, তার ওপরে এমন টানাহেঁচড়া সহ্য করতে হয়েছে! আর খালি পেটে রাখা যাবে না।’’


আগুন লাগার খবর পেয়ে এসএসকেএমে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার।

অ্যাকাডেমিক বিল্ডিংয়ের সামনে দেখা মিলল বছর কুড়ির সন্তোষ রামের। এক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়ানোর সময় নেই। হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী রামবিহারী রামের ছেলে সন্তোষ অন্য দিনের মতোই রোনাল্ড রস বিল্ডিং-এর উল্টো দিকে চায়ের দোকানের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে গুলতানি মারছিলেন। এই সময়ে হঠাৎ ধোঁয়া দেখতে পান। ভেসে আসে বহু মানুষের চিৎকার। সন্তোষ বলেন, ‘‘তখন আর এক মুহূর্তও দাঁড়াইনি। কয়েক বছর আগে ঢাকুরিয়ার হাসপাতালে অতগুলো লোক মারা গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, ও রকম যেন না হয়। দৌড়ে ঢুকে গিয়েছি বিল্ডিংয়ের মধ্যে।’’ সন্তোষ জানান, তার পর তিনি আর তাঁর বন্ধুরা সিঁড়ি টপকে টপকে ওপরে ওঠেন। ততক্ষণে অনেকে কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছেন। ডাক্তার-নার্সরা ছোটাছুটি করছেন। চার দিকে চিৎকার-হুটোপাটি। যাঁরা হাঁটাচলা করতে পারেন না, তাঁরা ‘বাঁচাও-বাঁচাও’ বলে আর্তনাদ করে চলেছেন। এ রকমই পাঁচ জনকে নীচে নামিয়েছেন সন্তোষ। ততক্ষণে নীচে অন্যান্য বিল্ডিং থেকে একাধিক ট্রলি, স্ট্রেচার চলে এসেছে। তাতে চড়িয়েই উদ্ধার করা রোগীদের অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং-এ পৌঁছে দিয়েছেন তিনি।

এক রোগীর আত্মীয় সরফরাজ আলি বললেন, ‘‘আমার ছেলেকে যে দিন এখানে ভর্তি করেছিলাম, সে দিন ট্রলি পাওয়া যায়নি। পাঁজাকোলা করে ওয়ার্ডে নিয়ে আসতে হয়েছিল। এক গ্রুপ ডি কর্মীকে ট্রলি আনার কথা বলতে তিনি ১০০ টাকা চেয়েছিলেন। আর আজ দেখলাম সেই গ্রুপ ডি কর্মীই পড়িমরি করে ছুটছেন, ট্রলি আনছেন, রোগীদের সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ওঁদের এ ভাবে দেখব, কল্পনাই করিনি।’’

ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

SSKM Savior Tout Fire Accident
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy