বিমানবন্দরের সামনে তল্লাশি। বুধবার। ছবি: সুদীপ ঘোষ।
মাঝে মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধান! পরপর দু’টি হুমকি-ফোন এল দু’টি ভিন্ন পুলিশ কন্ট্রোল রুমে। দু’টি ক্ষেত্রেই ‘টার্গেট’ কলকাতা বিমানবন্দর।
এই দুই ফোনের জেরে মঙ্গলবার মাঝরাত থেকে বুধবার রাত পর্যন্ত বিমানবন্দর জুড়ে চলে তল্লাশি। কালঘাম ছুটে যায় পুলিশ ও বিমানবন্দরের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা সিআইএসএফ-এর। যদিও চিরুনি তল্লাশি চালিয়েও সন্দেহজনক কোনও ব্যক্তি বা বস্তু— কিছুই পাওয়া যায়নি।
তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, দু’টি ফোনই করেছিলেন ডানকুনির অরুণাভ সিংহ। প্রাথমিক ভাবে পুলিশ মনে করছে, ৩৫ বছরের ওই যুবক মানসিক ভারসাম্যহীন।
এ দিকে হুমকি-ফোন পাওয়ার পরে সিআইএসএফ-এর অতিরিক্ত ৭০ জন জওয়ানকে তল্লাশিতে লাগানো হয়। পার্কিংয়ে প্রতিটি গাড়িতে তল্লাশি চলে। মেটাল ডিটেক্টর, স্নিফার ডগ, ‘বম্ব ডিটেকশন অ্যান্ড ডিসপোজাল স্কোয়াড’-এর সাহায্যে চলে তল্লাশি। টার্মিনালের সামনে বেশিক্ষণ কোনও গাড়িকে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি।
নতুন টার্মিনালে প্রবেশের ১, ৩ ও ৪ নম্বর গেট খোলা ছিল। এ দিন যে সব যাত্রী বিমানবন্দরে ঢুকেছেন, তাঁদের মালপত্র এক্স-রে যন্ত্রে পরীক্ষা করা হয়েছে। টার্মিনালের ভিতরে সন্দেহভাজন কেউ রয়েছে কি না তা দেখতে সাদা পোশাকে ঘুরেছেন নিরাপত্তারক্ষীরা। দেখা হয়েছে পুরনো টার্মিনাল, তার সামনের পার্কিংও।
পণ্য বিমান উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি পেয়ে এ দিন বাইরে থেকে কলকাতায় আসা এবং কলকাতা থেকে বাইরে যাওয়ার সব পণ্য পরীক্ষা করে দেখা হয়। বিমানবন্দরের অধিকর্তা অতুল দীক্ষিতের কথায়, ‘‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর মেনে যা যা করার কথা, সব করা হয়েছে।’’
প্রথম ফোনটা আসে মঙ্গলবার রাত ১টা ২৪ মিনিটে, লালবাজার পুলিশ কন্ট্রোলে। কেউ হিন্দিতে বলেন, ‘‘আরশাদ নামে এক জন কলকাতা বিমানবন্দর উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। তদন্ত করে দেখুন।’’ আরশাদের মোবাইল নম্বর বলে একটি নম্বরও দিয়ে দেন তিনি।
খবর যায় বিমানবন্দর ও বিধাননগর পুলিশে। শুরু হয় তল্লাশি। বুধবার সকালে সেই তল্লাশি যখন তুঙ্গে, তখন দ্বিতীয় ফোনটি আসে বিধাননগরের পুলিশ কন্ট্রোলে। ততক্ষণে টিভিতে তল্লাশির ছবি দেখে নিয়েছেন অরুণাভ। বিধাননগরের গোয়েন্দা-প্রধান সন্তোষ পাণ্ডে জানিয়েছেন, বিধাননগর পুলিশকে ফোনে অরুণাভ বলেন, ‘‘যা বলা হচ্ছে, তা কিন্তু সত্যি। আমি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা অফিসার।’’ অরুণাভ আরও বলেন, ‘‘১টা ৪৩ মিনিটে যে পণ্য বিমান ছাড়বে, তাকে উড়িয়ে দেওয়া হবে।’’
শোরগোল পড়ে যায় বিমানবন্দরে। লালবাজারে ফোন করে যে আরশাদের কথা অরুণাভ বলেছিলেন, শুরু হয় তাঁর খোঁজ। কিন্তু বুধবার সব বিমানের যাবতীয় যাত্রী-তালিকা পরীক্ষা করেও আরশাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। আরশাদের নম্বরে ফোন করে পুলিশ জানতে পারে, তা শহরের এক সংস্থার নিজস্ব নম্বর। সেই সংস্থায় আরশাদ বলে কেউ কাজ করেন না। পরে দুপুরে ওই নম্বরে ফোন করে দেখা যায়, তা বন্ধ।
রাতে লালবাজারে যে নম্বর থেকে অরুণাভ ফোন করেছিলেন, সেটি ছিল অসমের নম্বর। প্রাথমিক ভাবে পুলিশ মনে করে, অসম থেকেই কেউ ফোন করেছেন। ফলে যোগাযোগ করা হয় অসম পুলিশের সঙ্গে। বুধবার বিধাননগর পুলিশ কন্ট্রোলে নিজের মোবাইল থেকেই ফোন করেন অরুণাভ। তাঁর নম্বর পেয়ে বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে পুলিশ হানা দেয় ডানকুনির বাড়িতে। পুলিশকে দেখে শান্ত কন্ঠে অরুণাভ বলেন, ‘‘আপনারা কি সেনাবাহিনীর লোক! তল্লাশি যা হচ্ছে, তার চেয়েও জোরদার করতে হবে। আমি কি এসপিজি-কে (স্পেশাল প্রোটেকশন ফোর্স, যাঁরা প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকেন) ডেকে পাঠাব? আপনাদের কি একে-৪৭ লাগবে? আমি কি সেগুলো জোগাড় করে দেব?’’
সন্তোষ পাণ্ডে জানিয়েছেন, অরুণাভকে আটক করে জেরায় জানা যায়, রাতে লালবাজারের ফোনটিও তাঁরই করা। তখন তিনি মোবাইলের বদলে ‘ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল’ ব্যবস্থার সাহায্য নেওয়ায় লালবাজারের সিএলআই-এ ফুটে ওঠে অসমের একটি নম্বর।
পুলিশ জানিয়েছে, অরুণাভর মা মারা গিয়েছেন। তিনি এখন বাবার সঙ্গে থাকেন। ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। মাস তিনেক ধরে তাঁর মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। আত্মীয়েরা পুলিশকে জানিয়েছেন, মাঝে মধ্যেই অদ্ভুত কাণ্ড ঘটান তিনি। এ দিন তাঁকে বহুক্ষণ জেরা করা হলেও পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেনি। যদিও তাঁর ওই দু’টি ফোনে নাভিশ্বাস ছুটে যায় নিরাপত্তারক্ষীদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy