কলকাতা আমার কাছে এক একান্ত অ্যালবাম। তার হরেক ছবির সিপিয়া রঙে মিশে আছে আমার অনেক আবদার, অভিমান— কখনও তা সাদা-কালো, কখনও বা রঙ্গিন। চেনা দুঃখ, চেনা সুখ, চেনা চেনা হাসিমুখ, চেনা আলো, চেনা অন্ধকার— এমন স্বপ্নের কলকাতার পানে চাইলেই ওই দুরান্তের দিগন্ত হতে ঝরা পাতার মতো সময়ের ডানায় চেপে ভেসে আসে কত না স্মৃতিময় উড়োচিঠি, প্রেমেরও, প্রত্যাখানেরও! ‘তবুও ঝরা পাতা, যদি আবার কখনও ডাকো’!
দেশ ভাগের পরে কলকাতায় এসে টালিগঞ্জে আমার ঠাকুর্দা একটা ছোট্ট বাড়ি করেছিলেন। আমার বাবা ওই শরিকি বাড়িটার নাম দিয়েছিলেন ‘একান্নবর্তী’। ঠাকুর্দা মারা যাওয়ার পর ঠাকুরমা একাই থাকতেন ওই বাড়িতে। বাড়ির অন্য সদস্যরা যে যার মতো আলাদা বাড়ি করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। শুধু ফি বছর পুজোর সময় আমার বাবার উদ্যোগে ‘একান্নবর্তী’-তে সমবেত হত সকলে। আমরা পিঠোপিঠি তুতো-ভাইবোনেরা ওই একচিলতে বাড়িটায় হুলুস্থুলু বাধিয়ে দিতাম। বাবা আমাদের কচিকাঁচাদের জন্য একটা ক্লাব করে দিয়েছিল, নাম দিয়েছিল ‘হুটোপুটি সংঘ’। সেই ক্লাব অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। বাবা যখন মারা গেলেন, আমার বয়স তখন ছয়। এর কিছু দিন বাদে চলে গেলেন ঠাকুরমাও। সেই থেকে ‘একান্নবর্তী’ তালাবন্ধ হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু বড় হওয়া ইস্তক আমার গোটা কলকাতাটাকেই ‘একান্নবর্তী’ বলে মনে হয়। মনে হয়, আমার বাবার সুরেলা স্মৃতিপট!
কলকাতার কথা উঠলেই আমার চোখে ভেসে কলেজ স্ট্রিট। ওই পাড়াতেই একটা হস্টেলে থাকত তপতী। অসাধারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইত, রবিতীর্থের ছাত্রী। আর আমি তখন জীবনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্য চরম লড়াই করছি। জীবিকার সন্ধানে আমি তখন সারাটা দিন কলকাতার পথে পথে পেটে আগুনের মতো খিদে আর আকন্ঠ পিপাসা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, অবসন্ন পায়ে। আর দিনশেষে ফিরতাম তপতীর কাছে, রবিঠাকুরের গান শুনতে। একদিন বিকেলে, ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে, কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে তপতী দেখা করতে বলল আমাকে। গেলাম, গিয়ে দু’জনে বসলাম ছাত্রভবনের সিঁড়িতে। সেদিন সেই আলো-আঁধারের আড়ালে তপতী বলল, “কাল চলে যাচ্ছি দেশের বাড়ি। আর হয়তো দেখা হবে না। কত কথা যে বলা হল না তোকে। আর বলা হবেও না।” সেদিন আমি তপতীর আর কোনও ‘কথা’ শুনতে চাইনি। চেয়েছিলাম গান শুনতে। তপতী আমার হাত দু’টো ধরে গেয়ে উঠেছিল, ‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না, শুকনো ধুলো যত’। তপতী সেদিন গাইছিল না, কাঁদছিল, বৃষ্টির মতো। আর আমি ভিজে যাচ্ছিলাম সেই বৃষ্টিতে, যেমন করে গাছেরা ভেজে, আড়ালের খোঁজে পালিয়ে না গিয়ে। সে দিনের সেই জলছবি আজও উজ্জ্বল আমার হিয়ার মাঝে। স্মৃতি তো এমনই হয়, ঝকঝকে, সোনা। কলকাতা আমার ঠিক তেমনই এক স্মৃতিকণা! গত বছর কলকাতা গিয়েছিলাম দিন কয়েকের জন্য। একদিন বিকেলে একটা শপিং মলের সামনে গাড়ি থেকে নেমে দেখি, তপতী দাঁড়িয়ে আছে। কেন কে জানে তেমন করে কথা বলতে পারলাম না আমরা। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম দু’জন দু’জনকে, অনেক ক্ষণ ধরে। আর মনে মনে ভাবলাম, এমন কিছু ‘হঠাত্ দেখা’ আছে বলেই তো আমার কলকাতা এখনও তেমনি অপরূপা!
কলকাতা আমার কাছে ধুলি-ধূসর এক মায়াবী বইমেলা, যেখানে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আমার জীবনের সেরা বান্ধবী সুতপা-কে। এর পরে কত সকাল-সাঁঝে বিকেল-রাতে হাতে হাত রেখে হেঁটেছি আমরা! কখনও পঁচিশে বৈশাখের সকালে রবীন্দ্রসদন বা জোড়াসাঁকোয়, কখনও অ্যাকাডেমিতে কখনও বা নন্দনে। কলকাতার প্রতি পথে জড়িয়ে আছে আমাদের বিপ্লবী প্রেম। অবশেষে কলকাতার ঘটকালিতেই আমাদের সেই নিবিড় বিয়ে। আমার মেয়ের জন্মও তো সেই কলকাতাতেই। নাম লগ্নজিতা। পৃথিবীর অপার্থিব আলোয় যেদিন প্রথম দেখলাম ওই সদ্যপ্রসূতাকে, সেদিন ওর নরম তুলতুলে চিবুকে আমি ‘গীতবিতান’ ছুঁইয়ে দিয়েছিলাম। সেই মেয়ে এখন দুরন্ত কিশোরী। এই মার্কিন মুলুকে সে এখন গিটার বাজিয়ে রবি ঠাকুরের গান গায়, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’! আর তক্ষুনি আমার হৃদমাঝারে কলকাতার অগণন স্মৃতি কেবলই আসে যায়, যেমন করে চলন্ত ট্রেনের জানলার ওপারে সরে সরে যায় নয়নাভিরাম দিগন্তিকা।
আমার কাছে কলকাতা মানে বন্ধু নীহাররঞ্জন। সাতাত্তরে যখন ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বিজয় সমাবেশ হল, আমরা তখন ‘নবীন কিশোর’। তারই ‘উত্তরাধিকার’ নিয়ে আমরা যখন সদ্য যৌবনে, তখনই সেই বিরাশির শান্তিমিছিল, আর সেদিনই নীহাররঞ্জনের সঙ্গে আমার পরিচয়। স্লোগান ছাপিয়ে সলিলের সুরে সে সেদিন বিদ্রোহের গান গাইছিল সে, ‘কার গৃহে প্রদীপ জ্বলেনি, কার বাছার অন্ন জোটেনি, ওগো প্রিয় মন, খোলো বাহুডোর, পৃথিবী আমারে যে চায়’! কলকাতার পথে-প্রান্তরে ‘একটু পা চালিয়ে’ হাঁটতে হাঁটতে আমরা সেদিন বুঝে গিয়েছিলাম, লড়াই করে বাঁচতে হলে এই কলকাতার ‘রাস্তাই একমাত্র রাস্তা’। এরপর অজস্র মধ্যরাতে নাটকের মহড়া সেরে বা ছাপাখানা থেকে লিটল ম্যাগাজিনের প্রুফ দেখে বেরিয়ে আমি আর নীহাররঞ্জন নেমে পড়েছি কলকাতার মাঝপথে। আমরা দু’জন একসাথে হেঁটেছি আর ভেবেছি, চিরটাকাল মাঝরাতের কলকাতাকে শাসন করব আমরাই, কলকাতারই মতো লক্ষ্মীছাড়া কয়েকজন যুবক। আর এই আমরাই একদিন দিন বদলে দেব, পাল্টে দেব কলকাতাকে। কলকাতা সেই পাল্টেই গেল! আমার ‘লালঝান্ডা’—র শহর বরণ করে নিল ‘পরিবর্তন’—কে, এগারো সালের এক আমজনতার অপরাহ্নে। এই কলকাতারই এক ‘সাধারণ মেয়ে’ সেদিন সাড়ে তিন দশকের অচলতার ইতিহাসকে সমঝে দিলেন, ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’! পথ খুঁজে দেওয়া কলকাতা তাই আমার কাছে এক আজব ভুলভুলাইয়াও! কখনও সে স্বপ্ন, কখনও সে সম্ভাবনা, কখনও স্মৃতি! পরবাসের অবকাশে যখন দেশে যাই, আমার বিমান যখন মাটির কাছাকাছি নামতে থাকে, আমি যখন দূর থেকে দেখতে পাই ত্রিফলা আলোর শিকলে মোড়া আমার রূপকথার শহরকে, কলকাতা তখন আমাকে সতর্ক করে দেয়, ‘শিকড়টা কিন্তু ক্রমশ আলগা হয়ে যাচ্ছে’! সত্যিই তো, উদ্বাস্তু পরিবারের পরম্পরা আমার, সেই তো ঘুরে ফিরে আটকে গেছি প্রবাসের বিত্ত-বিলাসের শরণার্থী শিবিরে! আর এমনই আত্মবিলাপের মুহূর্তে, অনেক দিনের পরে যেই না কলকাতার দেখা পাই, ঠিক তক্ষুনি আমার অনেক ভিতরে রবি ঠাকুরের সেই গানটা বেজে ওঠে, ‘হঠাত্ দেখা পথের মাঝে, কান্না তখন থামে না যে’!
—নিজস্ব চিত্র।
জন্ম-কর্ম কলকাতায়। এক সময়ে স্কুল-কলেজে রাজনীতি, লিটল ম্যাগাজিন, লেখালেখি, থিয়েটার চর্চা ছিল নিয়মিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর। সাংবাদিকতাও করেছেন দীর্ঘ দিন। বই, গানবাজনা, নাটক, সিনেমা আর ভ্রমণ খুবই প্রিয়। বর্তমানে আমেরিকায় সাংবাদিকতার কাজে যুক্ত। সেখানকার টেনেসি প্রদেশের রাজধানী শহর ন্যাসভিলে বসবাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy