Advertisement
০৩ মে ২০২৪

কড়া বার্তাই সার, আরও ছড়াচ্ছে সিন্ডিকেট-জাল

এক দিকে সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকা যাবে না বলে দলের সাংসদ, বিধায়কদের ডেকে কড়া বার্তা দিচ্ছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। অন্য দিকে তখন সিন্ডিকেট নিয়ে গোষ্ঠী-সংঘর্ষ আরও ছড়াচ্ছে! নিউ টাউনের পরে এ বার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে দমদমে। এ বারের সংঘর্ষে গুরুতর জখম এক যুবক।যার ফলে সিন্ডিকেট-জালে আরও জর্জরিত হয়ে পড়ছে শাসক দল।

বিজয় সাহা ওরফে ডন

বিজয় সাহা ওরফে ডন

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৪ ০৪:০১
Share: Save:

এক দিকে সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকা যাবে না বলে দলের সাংসদ, বিধায়কদের ডেকে কড়া বার্তা দিচ্ছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। অন্য দিকে তখন সিন্ডিকেট নিয়ে গোষ্ঠী-সংঘর্ষ আরও ছড়াচ্ছে! নিউ টাউনের পরে এ বার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে দমদমে। এ বারের সংঘর্ষে গুরুতর জখম এক যুবক।

যার ফলে সিন্ডিকেট-জালে আরও জর্জরিত হয়ে পড়ছে শাসক দল।

নিউ টাউনের ঘটনার প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার বিধানসভায় খাদ্যমন্ত্রী তথা দলের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের ঘরে এলাকার সাংসদ-বিধায়কদের নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। মাত্রই মিনিটদশেকের বৈঠকে মুকুলবাবু কড়া বার্তা দিয়েছেন, সিন্ডিকেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকলে তৃণমূলে থাকা যাবে না। সিন্ডিকেটকে কেন্দ্র করে দুষ্কৃতীদের গোলমালে নিজেদের জড়িয়ে পড়া চলবে না, শাসক দলের জনপ্রতিনিধি হিসাবে পুলিশ-প্রশাসনের কাজে হস্তক্ষেপও চলবে না। কিন্তু তাঁর ওই বৈঠকের আগের রাতেই দমদমের মধুগড়ের ঘটনা তৃণমূল নেতৃত্বের অস্বস্তি আরও প্রকট করে দিয়েছে।

মধুগড়ে বুধবার রাতে একই নেতার অধীনস্থ দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে সোমনাথ সাধুখাঁ ওরফে নাড়ু নামে এক যুবক গুরুতর জখম হয়ে এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। হাসপাতাল সূত্রের বক্তব্য, ভারী কোনও বস্তু দিয়ে তাঁর মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ অবশ্য এ দিন রাত পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। যে নেতার অধীনে-থাকা দুই গোষ্ঠীর মধ্যে গোলমালের অভিযোগ, তাঁকে দমদম লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায়ের প্রচারে বড় ভূমিকা নিতে দেখা গিয়েছিল।

পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রের খবর, দমদমের পূর্ব সিঁথিতে এলাকা, সিন্ডিকেট এবং সাট্টার ঠেক দখলকে কেন্দ্র করে এক স্থানীয় তৃণমূল নেতার দু’দল অনুগামীর মধ্যে বাঁশ, লাঠি, রিভলবার নিয়ে মারামারি হয়েছে। যদিও তৃণমূলের এক অংশের দাবি, তৃণমূল সর্মথক বলে পরিচয় দিয়ে কিছু দুষ্কৃতী এই গণ্ডগোল বাধিয়েছে। স্থানীয় সূত্রের খবর, লোকসভা ভোটে তৃণমূলের জয় উপলক্ষে একটি ক্লাবে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেছিলেন স্থানীয় তৃণমূল নেতারা। ওই অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন এই উৎসবের প্রধান উদ্যোক্তা তথা দক্ষিণ দমদম পুরসভার কাউন্সিলর ও মেয়র পারিষদ (জঞ্জাল) প্রবীর পাল ওরফে কেটি-ও। যাঁকে সৌগতবাবুর সঙ্গেই প্রচারে দেখা গিয়েছে ভোটের সময়। এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরেই উদ্যোক্তাদের উপরে কয়েক জন দুষ্কৃতী হামলা চালায় বলে অভিযোগ। সাংসদ সৌগতবাবু এই ঘটনার সঙ্গে সিন্ডিকেটের যোগাযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। স্থানীয় বিধায়ক তথা পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসুও বলেছেন, খাওয়া-দাওয়াকে কেন্দ্র করেই গোলমাল হয়েছে বলে প্রাথমিক ভাবে তিনি খবর পেয়েছেন। তবে এর পিছনে অন্য কিছু আছে কি না, তা-ও খোঁজ নিয়ে দেখার কথা বলেছেন তিনি।

সিন্ডিকেটকে ঘিরে লাগাতার গোলমালে দলের ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে বুঝেই এ দিন বিধানসভায় জ্যোতিপ্রিয়বাবুর ঘরে সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার, বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত ও সুজিত বসু, শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসু, দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির সদস্য ও মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস, বিধাননগর পুরসভার চেয়ারপার্সন কৃষ্ণা চক্রবর্তী, দলের জেলা পর্যবেক্ষক নির্মল ঘোষ এবং পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন মুকুলবাবু। বৈঠকে সকলকেই বলে দেওয়া হয়েছে, সিন্ডিকেট ব্যবসার সঙ্গে দলের কেউ যুক্ত নেই, থাকবেও না। সিন্ডিকেট ব্যবসা নিয়ে গোলমাল হলে তা নিয়ন্ত্রণ করবে পুলিশ-প্রশাসন। সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্তদের কাউকে তৃণমূলের কেউ আশ্রয় দিলে তা দল-বিরোধী কাজ হিসেবেই দেখা হবে।

নিউ টাউনে সিন্ডিকেট নিয়ে শাসক দলের নেতা-নেত্রীর অনুগামীদের নিয়ে সংঘর্ষ মারাত্মক আকার নেওয়ায় বিড়ম্বনায় পড়ে বুধবারই মুকুলবাবু দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে এক প্রস্ত আলোচনা করেছিলেন। বিষয়টি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্তও পৌঁছেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা এ দিনই বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে ডেকে কথা বলেছেন। আলোচনা হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী-মুকুল-রাজীবের মধ্যেও। সেখানে সিন্ডিকেট সমস্যাও আলোচ্য ছিল বলে প্রশাসনিক একটি সূত্রের খবর। বিধানসভায় আজ, শুক্রবার পুলিশ বাজেটের সময় মুখ্যমন্ত্রী অধিবেশনে এলে বিরোধীরাও বিষয়টি তুলতে পারেন। তখন মুখ্যমন্ত্রী কী বার্তা দেন, সে দিকে নজর রয়েছে শাসক দলের নেতাদেরও।

মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একাধিক বার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তৃণমূল করলে সিন্ডিকেট ব্যবসায় থাকা যাবে না। তাতে যে বিশেষ কাজ হয়নি, নিউ টাউন থেকে দমদমে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়াতেই তার প্রমাণ। এই পরিস্থিতিতেই এ দিনের সংক্ষিপ্ত বৈঠকে মুকুলবাবু স্পষ্ট জানিয়ে দেন, সিন্ডিকেট ব্যবসার সঙ্গে যুক্তদের মধ্যে কোনও গোলমাল হলে তা সামলাবে প্রশাসনই। এই ব্যাপারে দলের কোনও নেতা মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করলে বা পুলিশকে ফোন করে অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করলে তা দল-বিরোধী কাজ বলে গণ্য করা হবে। বৈঠকের পরে মুকুলবাবু কোনও মন্তব্য করেননি। মুখ খোলেননি বিধায়ক সব্যসাচীও। তবে সাংসদ কাকলি বলেন, “আমি চাই, এলাকায় শান্তি থাকুক।”

তৃণমূল নেতৃত্বের বারংবার হুঁশিয়ারি এবং তার পরে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে প্রশ্ন উঠছে— সিন্ডিকেটই যেখানে রুটি-রুজির সহজ মাধ্যম, রাজনৈতিক নেতাদের এলাকায় প্রতিপত্তি বাড়ানোর অন্যতম হাতিয়ার, সেখানে কি কেবল দলীয় নির্দেশ জারি করে তা ঠেকানো সম্ভব? বামফ্রন্ট আমলে একই অভিযোগ বারবার উঠতো। উত্তর ২৪ পরগনা জেলাতেই সিপিএম নেতৃত্বকে সিন্ডিকেটের সঙ্গে দলের যোগসাজশ ঠেকাতে নির্দেশিকা জারি করতে হয়েছিল। প্রয়াত প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসকেও অনুশাসন ফেরানোর জন্য হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। তবে বাম আমলে সিন্ডিকেটের সঙ্গে শাসক দলের নেতারা খোলাখুলি জড়াতেন কম, গোষ্ঠী-বিবাদ রাস্তায় নেমে আসার ঘটনাও কম ছিল। তৃণমূলে আরও অনেক কিছুর মতো এই বিষয়টিও অনেক খোলামেলা। বাম-সিন্ডিকেটের লোকজনেরা তৃণমূলের সঙ্গে এখন হাত মিলিয়ে কাজ করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। নিউ টাউন, রাজারহাট বা দমদমের একাধিক তৃণমূল নেতার পাশাপাশি ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে অন্য ধরনের সিন্ডিকেট চালানোর জন্য তৃণমূলের অন্দরে অভিযোগ রয়েছে মুকুলবাবুর বিধায়ক-পুত্রের দিকেও।

দমদমের ঘটনা নিয়ে ব্যারাকপুরের অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার সুরেশ চ্যাটভি বলেছেন, ‘‘একটি পিকনিককে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে। অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।” কারা এই গোলমাল করল? চ্যাটভির বক্তব্য, “দুই পাড়ার মধ্যে গোলমাল। এখানে কোনও রাজনৈতিক দলের কেউ জড়িত কি না, তা আমরা খতিয়ে দেখছি।”

দমদমের বিধায়ক ব্রাত্যবাবু এমন ঘটনায় উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, “মধুগড় এলাকায় একটা খাওয়া-দাওয়াকে কেন্দ্র করে এই গণ্ডগোল হয়েছে বলে শুনেছি। এর মধ্যে কোনও সিন্ডিকেট বা এলাকা দখল নিয়ে লড়াই রয়েছে কি না, খোঁজ নিয়ে দেখব। এর সঙ্গে কোনও স্থানীয় নেতা জড়িত থাকলে তিনি যতই প্রভাবশালী হোন না কেন, ছাড় পাবেন না!” সাংসদ সৌগতবাবু অবশ্য ঘটনার সঙ্গে সিন্ডিকেট বা দলের নেতাদের জড়িত থাকার অভিযোগ উড়িয়েই দিয়েছেন। তাঁর দাবি, মধুগড় এলাকায় দু’টো দলের মধ্যে পিকনিক হচ্ছিল। খাওয়া-দাওয়ার পরে কিছু লোক মারপিটে জড়িয়ে পড়ে। সাংসদের কথায়, “দমদম লোকসভা কেন্দ্রে কোনও সিন্ডিকেট নেই। তৃণমূলের নেতাদের মধ্যে কোনও গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বও নেই।”

যে নেতার অনুগামী দুই গোষ্ঠীর মধ্যে মধুগড়ে গোলমালের অভিযোগ, সেই কেটি-কে এ বার নির্বাচনী প্রচারে সৌগতবাবুর সঙ্গেই দেখা গিয়েছে। এ ব্যাপারে সৌগতবাবুর মন্তব্য, “মধুগড় এলাকা থেকে সিপিএমকে উৎখাত করেছেন কেটি-ই।” আর কেটি-র দাবি, “এই এলাকায় এক সময়ে দাপিয়ে-বেড়ানো সিপিএমের গুন্ডা দীপক বিশ্বাসের অনুগামীরা এলাকায় ঢুকতে চাইছে। আমরা বাধা দিচ্ছি।” দীপক এখন জেলে। সিপিএমের নেতা পলাশ দাসের পাল্টা অভিযোগ, “তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বখরা নিয়ে গণ্ডগোলের জেরেই এই ঘটনা।”

মধুগড়ে বুধবার রাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে দাবি-করা তৃণমূল কর্মী বিজয় সাহা এ দিন বলেন, রাত পৌনে ১২টা নাগাদ হঠাৎ খালপাড়ের দিকের গলির অন্ধকার থেকে উদয় হয় কয়েকটি ছায়ামূর্তি! তাদের কয়েক জনের হাতে বাঁশ, লাঠি, এমনকী রাইফেলও। অতর্কিতে স্থানীয় অগ্রদূত ক্লাবে পিকনিক-করা যুবকদের আক্রমণ করে ওই হামলাকারীরা। দাঁড়িয়ে-থাকা যুবকেরা যে যার মতো পালানোর চেষ্টা করলেও সবাই পারেননি। বিজয়বাবু বলেন, “ওরা আমাকে সামনে পেয়ে আমার গালে ক্ষুর চালায়। কোনও রকমে আমি ওদের হাত ছাড়িয়ে পালিয়ে যাই।” পিছনে তাকিয়ে বিজয়বাবু দেখেছিলেন, হামলাকারীরা সোমনাথকে হাতের সামনে পেয়ে বাঁশ দিয়ে পেটাচ্ছে। সোমনাথ মাটিতে পড়ে গেলে মাটি থেকে বড় পাথর তুলে তার মাথা লক্ষ্য করে মারা হয়। রাস্তার চার দিকে রক্ত ছিটকে যেতে দেখেছিলেন বিজয়বাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

syndicate new town tmc
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE