Advertisement
০৪ মে ২০২৪

পরিস্রুত জল কবে মিলবে, জানতে চায় বিস্তীর্ণ এলাকা

বেলেঘাটায় ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বীণাপাণি দাস। দীর্ঘকাল ধরে কলকাতায় বসবাস করছেন। এখনও পানীয় জলের জন্য হা-পিত্যেশ করে থাকতে হয়। টালার পরিস্রুত জল মেলা ভার। গভীর নলকূপের জলই এখনও তাঁর ভরসা।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৫ ০২:২০
Share: Save:

বেলেঘাটায় ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বীণাপাণি দাস। দীর্ঘকাল ধরে কলকাতায় বসবাস করছেন। এখনও পানীয় জলের জন্য হা-পিত্যেশ করে থাকতে হয়। টালার পরিস্রুত জল মেলা ভার। গভীর নলকূপের জলই এখনও তাঁর ভরসা।

পেশায় চিকিৎসক ৯২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সরোজ সিংহের আবার অভিযোগ, প্রয়োজন মতো জলই মিলছে না। এলাকার কাউন্সিলর এবং জল দফতরের আধিকারিকদের বলেও কিছু হচ্ছে না।

দক্ষিণ কলকাতার লেক গার্ডেন্স পিপলস্ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবার প্রশ্ন তুলছেন গভীর নলকূপের জলের মান নিয়ে। তাঁর বক্তব্য, “আমরা গার্ডেনরিচের পরিস্রুত জল পাওয়া থেকে বঞ্চিত। গভীর নলকূপের জল খেতে হচ্ছে। সে জল প্রচুর আয়রনে ভরা। রয়েছে আর্সেনিকের ভয়ও।” তাতে অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা যে বাড়ছে, তা জানাতে কসুর করেননি ওই অ্যাসোসিয়েশনের বাকিরাও। বলছেন, “পুর-কর্তৃপক্ষ এবং জন প্রতিনিধিদের জানিয়েও কোনও ফল হচ্ছে না।” ১১৩ ওয়ার্ডের বাসিন্দা সঞ্চয়ন ভট্টাচার্যের আক্ষেপ, “গত দেড় বছর ধরে চরম জলকষ্টে ভুগছি। স্থানীয় পুর-প্রতিনিধিকে স্মারকলিপিও দিয়েছি। সমাধান হয়নি।” পুরসভার ১২৬ নম্ভর ওয়ার্ডের একাংশের বাসিন্দারাও জলকষ্টে ভুগছেন বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে।

শুধু এঁরা নন, জল নিয়ে ভোগান্তি চলছে শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। ভুগছে বাবুবাগান, যাদবপুর, সন্তোষপুর, ঢাকুরিয়া, টালিগঞ্জ। কলকাতা পুরসভার ৯১-১১৫ এবং ১৩৩-১৪১ অর্থাৎ, দক্ষিণেই মোট ৩৪টি ওয়ার্ডের বেশ কিছু এলাকায় পৌঁছচ্ছে না গার্ডেনরিচের মিষ্টি জল। যার ফলে জেরবার ওই সব এলাকার বাসিন্দারা। একই শহরে কিছু মানুষ পরিস্রুত জল পাবেন, আর একদল বঞ্চিত থাকবেন! এমন ভাবে কত দিন চালাতে হবে, ‘পুর-প্রশ্নের পুরো জবাব’ চেয়ে এ কথাই বলেছেন তাঁরা।

কী বলছেন, পুর-প্রতিনিধি ও বিভাগীয় অফিসারেরা?

৫৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জীবন সাহা বলেন, “এই এলাকায় কয়েকটি গভীর নলকূপ এখনও আছে। ওই জল খেতে হয় কিছু বাসিন্দাকে। মাস খানেকের মধ্যে ধাপার জল পৌঁছে গেলে সমস্যা থাকবে না।”

৯২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দার অভিযোগের জবাবে স্থানীয় কাউন্সিলর সিপিআই-এর মধুছন্দা দেব বলেন, “এ কথা ঠিক যে, আমার ওয়ার্ডে পানীয় জলের সমস্যা রয়েছে। তেলিপাড়ায় গার্ডেনরিচের জল সরবরাহ করার জন্য একটি বুস্টার পাম্পিং স্টেশন নির্মিত হলেও তা কাজ করছে না। তাই সমস্যা হচ্ছে।” জল সরবরাহ দফতরের এক অধিকারিক জানিয়েছেন, গার্ডেনরিচ থেকে যথেষ্ট জল আসছে না বলেই তা কাজ করছে না।

৭১ নম্বর ওয়ার্ডে ওঠা প্রশ্নের জবাবে জল দফতরের এক আধিকারিক জানান, এখানে জলের জোগান যথেষ্ট। জলে লোহা বা ভারী ধাতু থাকার আশঙ্কা নেই। তবে নির্দিষ্ট ভাবে কোনও বাড়ির সার্ভিস লাইন খারাপ থাকলে সমস্যা হতে পারে।

১১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সঞ্চয়নবাবুর তোলা প্রশ্নের জবাবে তৃণমূল কাউন্সিলর অনীতা কর মজুমদার বলেন, “আমার ওয়ার্ডে পানীয় জলের সমস্যা আছে। গার্ডেনরিচ থেকে জল এনে সরবরাহের জন্য প্রফুল্ল পার্কে একটি বুস্টার পাম্পিং স্টেশন নির্মাণের কাজ চলছে। এই বছরের শেষে এই কাজ হয়ে গেলে আর সমস্যা থাকবে না। এখন নলকূপের উপরে নির্ভর করতে হচ্ছে।”

১২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ওঠা প্রশ্নের উত্তরে তৃণমূলের কাউন্সিলর শিপ্রা ঘটক বলেন, “আমার ওয়ার্ডে আনন্দনগর, ক্ষুদিরাম পল্লি, বসুন্ধরা পার্ক ও তার সংলগ্ন এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা আছে। পানীয় জলের পাইপ এখনও বসেনি।”

অথচ পুরবোর্ডের কর্তাদের হিসেবে শহরে পানীয় জলের চাহিদা প্রায় মিটে গিয়েছে। কিন্তু তা কি শুধু হাতে কলমে? এ নিয়ে ধন্দ রয়েই গিয়েছে। আর তা আরও প্রকট হয়েছে সম্প্রতি মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের একটি বক্তব্যের প্রেক্ষিতে। বর্তমান বোর্ডের শেষ অধিবেশন ছিল গত ৭ মার্চ। অধিবেশন শেষে মেয়র সগর্বে ঘোষণা করেন, “আমরা কলকাতা পুর-এলাকার ৯৫-৯৬ শতাংশ বাসিন্দার কাছে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে দিয়েছি।” নিজের বক্তব্যের সমর্থনে মেয়র জানান, টালা, গার্ডেনরিচ এবং মাস দুয়েক আগে চালু হওয়ায় ধাপা প্রকল্পের পরে কলকাতায় প্রায় সর্বত্রই পরিস্রুত জল পৌঁছে গিয়েছে। কলকাতায় পরিস্রুত পানীয় জলের জোগান যে বেড়েছে, তা স্বীকার করেছেন অনেকেই। এমনকী, কয়েক জন বিরোধী কাউন্সিলরও। তবে মেয়রের দাবি মানতে নারাজ তাঁরা। তৃণমূলেরই একাধিক মেয়র পারিষদের বক্তব্য, সকলের কাছে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছচ্ছে তখনই বলা যাবে, যখন কলকাতা শহরে আর একটিও গভীর নলকূপ থাকবে না।

পুর-পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে কলকাতায় পুরসভার বসানো ৩৭০টিরও বেশি গভীর নলকূপ রয়েছে। পুরসভার জল দফতরের এক আধিকারিক জানান, এ ছাড়া আরও পাঁচ হাজারেরও বেশি গভীর নলকূপ আছে। তা-ও বসানো হয়েছে পুরসভার অনুমতি নিয়ে।

কত জল ওঠে সেই সমস্ত নলকূপের সাহায্যে?

জল সরবরাহ দফতরের হিসেবে, গভীর নলকূপ থেকে ওঠা (৫ ঘণ্টা চললে) ১৫ কোটি গ্যালনের বেশি জল রোজ ব্যবহার হয় কলকাতায়। কিন্তু কলকাতা পুরসভা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, নদীর পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা হলেই বন্ধ হবে নলকূপের জলের ব্যবহার। ধাপা এবং গার্ডেনরিচের নতুন জলপ্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেলেও গভীর নলকূপ ব্যবহার বন্ধ হয়নি কেন, স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে তা নিয়ে।

জল সরবরাহ দফতরের মেয়র পারিষদ তথা কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আগের থেকে অনেক বেশি জায়গায় পরিস্রুত পানীয় জল যাচ্ছে।” তা হলে নলকূপের সংখ্যা কমছে না কেন? কেনই বা এখনও বাসিন্দারা জলের জন্য অভিযোগ করছেন? মেয়রের জবাব, “কে কী বলছেন, জানি না। শহরে নলকূপের সংখ্যা ক্রমশই কমছে।”

এরই মধ্যে আবার বিধানসভায় রাজ্যের মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র জানিয়েছেন, কলকাতার কয়েকটি এলাকায় পানীয় জলে সহনমাত্রার বেশি আর্সেনিক মিলেছে। যা শুনে রাজ্যের জনস্বাস্থ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং মেয়র বলেছেন, “কলকাতার মানুষ তো গঙ্গার পরিশোধিত জল খায়। তাতে আর্সেনিক থাকে না।” যদিও পুরসভার বিরোধী দলনেত্রী সিপিএমের রূপা বাগচীর বক্তব্য, “কয়েক হাজার গভীর নলকূপ এখনও পানীয় জল তুলে দিচ্ছে। তাই শহরের আশঙ্কা ঘোচেনি।”

তথ্য: অনুপ চট্টোপাধ্যায় এবং কৌশিক ঘোষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE