অঙ্কন: সুমিত্র বসাক
জলসাঘর! ভূতের রাজা দিল বর! কিংবা হ্যাংলাথেরিয়ম!
ঝালে-ঝোলে-অম্বলে, সাড়ে চুয়াত্তর বা তুমি আসবে বলে!
শব্দগুলোর কোনওটাই আমবাঙালির অচেনা নয়। কয়েকটির সঙ্গে আবার জড়িয়ে প্রিয় বই, সিনেমা বা গানের অনুষঙ্গও। আজকের কলকাতায় এই শব্দগুলোরই অন্য পরিচয়। গত কয়েক বছরে এমন নামেই শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণে মাথা চাড়া দিয়েছে বেশ কিছু রেস্তোরাঁ বা পানশালা। দেশজ শব্দে রেস্তোরাঁ বা বিপণির নামকরণ এই প্রথম নয়। কিন্তু পাড়ার মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, মণিহারী দোকানের স্তর ছাড়িয়ে তুলনায় একটু বেশি খরচের খানাপিনার ঠেকে এমন বাংলা নাম বড় একটা দেখা যেত না।
ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু কলকাতার পানভোজন বা কেনাকাটার জনপ্রিয় কেন্দ্রের তালিকা ঘাঁটলে বিজাতীয় গন্ধটাই প্রবল। কলকাতার আদ্যিকালের ‘স্পেনসেস’ কি উইলসনের হোটেল (আজকের গ্রেট ইস্টার্ন) থেকে ‘ফ্লুরিজ’, ‘মোক্যাম্বো’, ‘পিটারক্যাট’--- এই ট্র্যাডিশন চলছে। এমনকী, কলকাতায় উত্তর ভারতীয় খানার অন্যতম আদি ঠেক ‘অম্বর’ অবধি আমবাঙালির মুখে-মুখে ‘অ্যাম্বার’ হয়ে ওঠে। কলকাতার সাবেক কেবিন-কাফের পরিসরেও ইংরেজি নামেরই রমরমা (যেমন, সাবেক চিৎপুর রোডের অ্যালেন মার্কেটের পাশে ‘অ্যালেন্স কিচেন’)। শ্যামবাজার মোড়ে গোলবাড়ির কষা তার স্বাদ-মাহাত্ম্যেই ‘নায়ক’ হয়ে উঠলেও রেস্তোরাঁটির নাম কিন্তু ‘নিউ পঞ্জাবি হোটেল’।
এ-সব নামের সঙ্গে খাবারের বা পণ্যের চরিত্রের কার্যত কোনও মিল নেই। অ্যাডম্যান রাম রে-র ব্যাখ্যা, “আগে অনেক ক্ষেত্রেই রেস্তোরাঁ, বিপণীর নামের পিছনে যুক্তি নিয়ে মাথা ঘামানোর চল ছিল না। এখন নামের মধ্যেও বিপণনের দিকটা ভাবা হচ্ছে।”
পুরনো কলকাতার কষা মাংসকে কুর্নিশ জানিয়ে ‘কষে কষা’ বা ‘সিঙ্গিং বার’-এর নাম ‘তুমি আসবে বলে’ রাখার যুক্তি আছে। ক’বছর আগে ঢাকুরিয়ার কাছে ‘তোমাকে চাই’ বলে পাঁচমিশেলি সামগ্রীর দোকান ছিল। কসবায় ফাস্টফুড আউটলেটের নাম ছিল GO-গ্রাস! গানপানের ঠেকে দেবদাস বা জলসা-ghar নামও মানানসই। এসএমএস বা সোশ্যাল নেটওয়ার্কে মজে-থাকার যুগে মাঝেমাঝে সাইনবোর্ডটাও বাংলা ও রোম্যান অক্ষরের মিশেলে লেখা হচ্ছে।
“নামে একটা বাঙালিয়ানা থাকবে, আবার কারও বুঝতে অসুবিধে হবে না, এমন নামই খুঁজছিলাম!”--- বলছেন, মাছের বিচিত্র পদের রেস্তোরাঁ ‘ফিশফিশ’-এর কর্ণধার অনিরুদ্ধ গুহরায়। রেস্তোরাঁর নামে মাছের ব্যাপার আছে, আবার বাংলা ফিসফিস-এর সঙ্গে ধ্বনিগত সাযুজ্জ্যকে মিলিয়ে রসিকতার মেজাজ! বিরিয়ানি-কাবাব ও নর্থ ইন্ডিয়ান রান্নার চিলতে দোকান ‘হ্যাংলাথেরিয়ম’-এর কর্তা অভিজিৎ মজুমদার সুকুমার রায়ের ভক্ত। রোম্যান অক্ষরে হ্যাংলাথেরিয়ম লেখার সময়ে পাশে সুকুমার রায়ের সৃষ্ট চরিত্রটির ছবিও রেখেছেন। কয়েক বছর আগে একটি শিল্প-গোষ্ঠীর হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করে ‘নোলা’ রেস্তোরাঁটিও।
কিন্তু এমন বাঙালিয়ানা ঘেঁষা নাম কলকাতার মতো বহুভাষাভাষী পাঁচমিশেলি শহরে চলবে? শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের চোখে, “এ এক ধরনের নতুনত্ব! বাঙালিদের কাছে শুনে অন্য ভাষার মানুষও তো আসতে পারেন।”
তবে অতীতের বাঙালিও ‘কমলালয়ে’ কেনাকাটা সারত। পানীয়ের খোঁজে যেত ভবানীপুরের ‘তৃপ্তি’তে। যেমন এ কালের বাঙালি কিউপিজ বা ওহ্ ক্যালকাটা-তেও দিব্যি বাঙালি রান্না খেতে ঢুকছে। রাম রে-র মতে, “আসলে নামটা মানানসই হওয়াই বড় কথা। তবে অচেনা ভাষারও আকর্ষণ থাকে।” চিনে রেস্তোরাঁ চাংওয়া, নানকিং-রা এ ভাবেই বাঙালির প্রিয়জন হয়ে ওঠে। এ যুগে কলকাতার ভজহরি মান্না-ও বেঙ্গালুরু, মুম্বই, পুরী সর্বত্র স্বনামেই গৃহীত হচ্ছে।
বিপণনের যুদ্ধে স্থানীয় বৈশিষ্ট্য এখন মোক্ষম হাতিয়ার। বেঙ্গালুরুতে গ্রামীণ কন্নড় খানার রেস্তোরাঁ হাল্লিমানে (কন্নড় শব্দটির অর্থ, গ্রাম্য কুটির)। বা হায়দরাবাদে অন্ধ্রের খানা চাখার পরিশীলিত রেস্তোরাঁ রায়লসিমা রুচুলু। বাংলাদেশেও বাংলা নামের বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগের ছড়াছড়ি। ঢাকার একটি সঙ্গীতবহুল কাফে-র নাম কোমল গান্ধার। আবার হুগলির হিন্দমোটরে এক মাল্টিকুইজিন রেস্তোরাঁর সরস নামকরণ, ‘খাইবার পাস’।
সার্থক নামের খোঁজে কথ্য বাংলার দ্বারস্থ হওয়াকে স্বাগত জানাচ্ছেন ডেরেক ও’ব্রায়েন। বাংলায় সড়গড় অ-বাংলাভাষী ‘ক্যালকাটান’ ডেরেকের কথায়, “একে বলে, থিংক লোকাল, অ্যাক্ট গ্লোবাল। রেস্তোরাঁ, মল--- সব-কিছুতে স্থানীয় মেজাজ ধরতে পারলে কেল্লা ফতে।”
তবে সতর্কীকরণের জায়গাও থাকছে। খাবার বা পণ্যের মানটাই আসল। সেটা ঠিক না-হলে, সব পণ্ড।
অগত্যা ফের শেক্সপিয়র শরণং, নামে কী বা আসে যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy