তাড়াতাড়ি চলুন। এখানে আর বেশি ক্ষণ দাঁড়ানো যাবে না!
পাশে দাঁড়ানো সহকর্মিণীর হাতে হাল্কা টান মেরে বললেন মধ্যবয়সী এক মহিলা। রাস্তার অন্য দিকেই তখন ছোট্ট ভ্যানের (আমজনতার পরিভাষায় ‘ছোট হাতি’) মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দিয়ে নেমেছেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। তিনটি পুর-এলাকায় ভোটের নামে কেমন ‘প্রহসন’ হয়েছে, কলকাতা হাইকোর্টে মামলার শুনানি চলতে চলতেই অস্থায়ী রাজ্য নির্বাচন কমিশনার কী ভাবে পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দিয়ে দিলেন— সে সব নিয়ে প্রশ্ন তুলে গুরুগম্ভীর বক্তৃতা করেছেন সবে। তাতে নির্বাচন কমিশনারের কী প্রতিক্রিয়া, জানা যায়নি। কিন্তু বিমানবাবুর শ্রোতাদের মধ্যে উপস্থিত কারও কারও বুক কাঁপছে!
না! বিমানবাবুর বাক্যবাণের জন্য নয়। এই আতঙ্ক এবং তাকে ছাপিয়ে আরও বেশি করে কৌতূহল বামেদের বিক্ষোভ সমাবেশের স্থান-মাহাত্ম্যের জন্য! শেক্সপিয়র সরণি থেকে পার্ক স্ট্রিটের দিকে একটু ঘুরেই সরোজিনী নায়ডু সরণির উপরে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দফতর। তার সামনেই রাস্তায় শুক্রবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্ষোভ সমাবেশ করছিল বামফ্রন্ট। এর প্রায় উল্টো দিকেই ঢুকে গিয়েছে অপ্রশস্ত যে রাস্তা, তার নাম রবিনসন স্ট্রিট। এবং সেই রাস্তা ধরে কয়েক পা এগোলেই ৩ নম্বর বাড়ি! গত জুন মাসের ঘটনার পরে ‘কঙ্কাল বাড়ি’ হিসেবেই যার খ্যাতি ছড়িয়েছে।
কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও সেই খ্যাতি যে এখনও অম্লান, টের পাওয়া গেল এ দিন বিকেলেই। বামফ্রন্টের সমাবেশ থেকে একের পর এক কর্মী-সমর্থক ভিড় করলেন আধো-অন্ধকার বাড়িটার সামনে। কঙ্কাল বাড়ি এবং তার পাশের বাড়ির মাঝখানের ছোট্ট জায়গায় বসেছে চায়ের দোকান। দোকান মানে পসরা সাজিয়ে বসা আর কী। ছাউনি বলে কিছু নেই। শরতের সন্ধ্যায় সেখানেই চায়ের কাপ হাতে কঙ্কাল-কাণ্ড নিয়ে চর্চা আর ভিতরে উঁকিঝুঁকি চলল দেদার।
বাগুইআটির অমিত দাস যেমন এসেছিলেন একা। সমাবেশের আশপাশে চা খেতে গিয়ে যখন দেখলেন রবিনসন স্ট্রিটে এসে পড়েছেন, কলেজপড়ুয়া মেয়েকে খবর পাঠালেন দ্রুত। পরে পিতা-পুত্রী একসঙ্গে হল কঙ্কাল বাড়ি দর্শন! সেই বাড়িতে দিদি এবং পোষা কুকুরের কঙ্কাল আগলে সংবাদ শিরোনামে আসা পার্থ দে পাভলভ মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসার পরে যে অনেকটাই সেরে উঠেছেন, সেই খবরও লোকের মুখে মুখে চর্চা হচ্ছে। তারই মধ্যে সিপিএম-সুলভ রাশভারী উচ্চারণে এক প্রৌঢ়কে বলতে শোনা গেল, ‘‘ভালই ফেঁদেছিল। এ বাড়ির বাজারদর সত্যিই বিপুল!’’
পার্থবাবু কি আবার এই বাড়িতে ফিরতে পারবেন? এই বাড়ি কি মাদার হাউস অধিগ্রহণ করে নেবে? রাতে লোকজন কমে গেলে জায়গাটা কেমন লাগে? এ রকমই নানা টুকরো কৌতূহল উড়ে বেড়াচ্ছিল গোটা চত্বর জুড়ে। চায়ের দোকানেই এক জন জানালেন, ঘটনার পরে পরে কঙ্কাল বাড়ি দেখার যে লাইন পড়ত, তেমনটা এখন আর হয় না। নির্বাচন কমিশনে লোকজন এসেছে বলেই ভিড়টা ঠেলে এসেছে রবিনসন স্ট্রিটে।
সমাবেশ শেষে পুনর্নির্বাচনে বুথের হিসেব মেলাতে ব্যস্ত সিপিএম নেতা রবীন দেবের কাছে গিয়ে তাঁর এক পরিচিত বলছিলেন, ‘‘দাদা, আপনার নামে রাস্তা আছে এখানে! ঘুরে এলাম।’’ যারপরনাই বিস্মিত রবীনবাবু জি়জ্ঞাসু চোখে তাকালেন। পাশ থেকে আরও এক জন ধরিয়ে দিলেন, ‘‘ওই যে, রবিনসন স্ট্রিট!’’ রবীনবাবু বললেন, ‘‘ওঃ! ওটা রবিনসন।’’ আগন্তুক বলে দিলেন, ‘‘আপনি সাহেব হলে ওই রবিনসনই নাম হয়।’’ দুলে দুলে হাসতে লাগলেন রবীনবাবু। হাসির অনুরণন কি ভেসে গেল কঙ্কাল বাড়ির অন্ধকার উঠোনেও?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy