Advertisement
০৪ মে ২০২৪

ভোটের স্লোগান: বৃষ্টি নামা নইলে কিচ্ছু মিলছে না

ভোটের অঙ্ক গুলিয়ে গিয়েছে! তৃণমূল, সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেসের টক্কর নয়। এ লড়াই অন্য। মাথায় কষে গামছা বেঁধে ঠা-ঠা রোদে কাঠের পাটাতনে হাতুড়ি পিটতে পিটতে বোঝাচ্ছিলেন ডেকরেটরের কর্মচারী। শনিবার বেলা দেড়টা। হাজরা মোড়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর সভার মঞ্চ বাঁধা চলছে। দক্ষিণ কলকাতার ব্যস্ত এলাকাতেও বাস-ট্যাক্সি মাত্র গুটিকয়েক।

গরমে নাজেহাল। প্রচারের ফাঁকে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিচ্ছেন উত্তর কলকাতার সিপিএম প্রার্থী রূপা বাগচী। ডাবের জলে গলা ভেজাচ্ছেন কংগ্রেস প্রার্থী সোমেন মিত্র। ক্লান্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।  —নিজস্ব চিত্র।

গরমে নাজেহাল। প্রচারের ফাঁকে ঠান্ডা জলের ঝাপটা দিচ্ছেন উত্তর কলকাতার সিপিএম প্রার্থী রূপা বাগচী। ডাবের জলে গলা ভেজাচ্ছেন কংগ্রেস প্রার্থী সোমেন মিত্র। ক্লান্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। —নিজস্ব চিত্র।

ঋজু বসু
শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৪ ০১:৪৯
Share: Save:

ভোটের অঙ্ক গুলিয়ে গিয়েছে! তৃণমূল, সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেসের টক্কর নয়। এ লড়াই অন্য। মাথায় কষে গামছা বেঁধে ঠা-ঠা রোদে কাঠের পাটাতনে হাতুড়ি পিটতে পিটতে বোঝাচ্ছিলেন ডেকরেটরের কর্মচারী।

শনিবার বেলা দেড়টা। হাজরা মোড়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর সভার মঞ্চ বাঁধা চলছে। দক্ষিণ কলকাতার ব্যস্ত এলাকাতেও বাস-ট্যাক্সি মাত্র গুটিকয়েক। তপ্ত পিচ থেকে ধোঁয়া ওঠার উপক্রম। ডেকরেটরের কর্মীটি বলে চলেছেন, “হাওয়া একটাই, লু আর লু! আর লড়াই বলতে, গরমের ভোট বনাম ভোটের গরম!”

সাধে কি খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত সমঝে চলছেন ‘ভোটের গরম’কে! বেলা ১১টা নাগাদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রংবেরঙের ট্যাবলো নিয়ে উত্তর কলকাতার পথ পরিক্রমায় ব্যস্ত, এমন সময় উদ্বিগ্ন দলনেত্রীর ফোন “এই গরমে বেরিয়েছেন! ছেলেমেয়েরা তো অসুস্থ হয়ে পড়বে।” ডাইনে-বাঁয়ে ঘুরে ঘুরে নিরন্তর নমস্কার করার ফাঁকে কোনও মতে সুদীপ তাঁকে বোঝালেন, কর্মীরা উৎসাহে ফুটছেন বলেই এমন কর্মসূচিতে বেরোনো হয়েছে। নেত্রী কিন্তু সাবধান করে দিলেন, “না না, যা করার রয়েসয়ে করুন। এখনও অনেক দিন প্রচার টানতে হবে।”

শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে রোড-শো রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে এসে ঠেকলে দেখা গেল, ঘেমে চান করে গিয়েছেন প্রার্থী। মঞ্চে গান, রবীন্দ্রনৃত্য (গরমে যুঝতে যুঝতে)সব মিটলে শাড়ির আঁচল-ওড়নায় আপাদমস্তক ঢেকে খড়কুটোর মতো নরম পানীয়ের ক্যান আঁকড়ে ধরলেন শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের সদস্যা দুই কলেজছাত্রী। কারও কারও হাতে ছিল দলের ঘাসফুল আঁকা ছাতা। তার ছায়ায় চাঁদি বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন।

ঘাসফুল থেকে চলে আসুন পদ্মফুলে। দক্ষিণ কলকাতার বিজেপি প্রার্থী তথাগত রায়কে দেখা গেল, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মজীবনে রোদ মাথায় পরিশ্রমের অভিজ্ঞতাকেই মূলধন করছেন। এ দিন সকালে বেহালা শিমুলতলা থেকে জিঞ্জিরাবাজার অবধি জিপ-পরিক্রমায় আড়াই লিটার জল খেয়েছেন তিনি। বলছেন, “এই জলটুকুই সম্বল। ঢকঢকিয়ে যা খাচ্ছি, সব ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছে।” প্রবীণ তথাগতবাবু সানস্ক্রিন মাখলেও রোদচশমা পরার কথা ভাবতেও পারেন না। বলেন, “চোখ ঢাকা থাকলে তো লোকে চিনতে পারবে না।”

ঠিক যেমন নেতা-প্রার্থীরা চিনতে পারছেন না এই নির্দয় এপ্রিলকে। কালবৈশাখীর শান্তি নেই। বিষফোড়ার মতো দোসর হয়েছে তাপপ্রবাহ। গরমে ভোট লড়ার পূর্ব-অভিজ্ঞতা থাকলেও প্রকৃতির এমন চোখরাঙানির মোকাবিলা আগে করতে হয়েছে বলে মনে করতে পারলেন না উত্তর কলকাতার সিপিএম প্রার্থী রূপা বাগচী। সরু রাস্তা, বস্তির ঘিঞ্জি মহল্লায় গাড়ি ঢুকবে না। ৫৮ নম্বর ওয়ার্ডে খানাবেড়িয়া হেঁটে চষে ফেলার পরে রূপার মন্তব্য, “সেদ্ধ হয়ে গিয়েছি! তবে একটা লাভ হচ্ছে!”

কী লাভ? রূপা হাসেন, “এই ক’দিনে রোদ মাথায় টো টো করার যা অভিজ্ঞতা হল, তাতে ভবিষ্যতে বাইরে বেরিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে বলে দিতে পারব, আজ কত তাপমাত্রা, কিংবা বাতাসে আর্দ্রতা কতখানি।”

লাভ-লোকসানের হিসেব পরে। তার আগে প্রচারের মাঠে যে অনেক খেলা বাকি। গোটা দেশের একেবারে শেষ ধাপে ভোট কলকাতায়। মানে, হাতে এখনও দু’হপ্তা। প্রার্থীদের অনেকেই ভেবে রেখেছিলেন, পদযাত্রা আর রোড-শোয়ের পাট যত দ্রুত সম্ভব হয় সেরে ফেলবেন। সে ক্ষেত্রে মে মাসে গরম আরও বাড়লে শুধু সন্ধের জনসভায় সময় দেবেন। সেই হিসেব পুরোই উল্টেপাল্টে গিয়েছে। এপ্রিলেই বেলা ১১টার পরে রাস্তায় থাকা দায়! অগত্যা গরমে সুস্থ থেকে প্রচার করতে নিজেদের মতো করে স্ট্র্যাটেজি খুঁজছেন সব ভোটপ্রার্থী।

যার একটা হল ম্যারাথনে দৌড়নোর কায়দায় এখনই ফুল পিকআপ না তোলা। সকাল-সকাল যত দূর সম্ভব এলাকা ‘কভার’ করে বাড়ি ঢুকে চাট্টি ঠান্ডা ঠান্ডা খেয়ে দুপুরটা ছাদের নীচে কাটানো। তবু সকালকেও তো সকাল বলে চেনা দায়! দক্ষিণ কলকাতার প্রার্থী মালা রায় ফার্ন রোড, কাঁকুলিয়া রোডের দিকটা জিপে ঘুরতে বেরিয়ে হতবাক “আটটায় রোদের যা তাত, বেলা বারোটা মনে হচ্ছে!” উত্তর কলকাতায় কংগ্রেসের পোড়খাওয়া ভোটযোদ্ধা সোমেন মিত্র এ দিন সকালেই টালায় প্রচার সেরেছেন। বলছিলেন, “আগে প্রচার শুরু করেছি বলে কেন্দ্রের অনেক জায়গা আগেই ঘোরা হয়ে গিয়েছে। এখন সবার কষ্টের কথা ভেবে বিকেলের প্রচারের সময় পিছোচ্ছি। রোদ নরম হলে পাঁচটা নাগাদ বেরোই।”

যাদবপুরের বাম প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী আবার খাওয়াদাওয়া নিয়ে ভীষণ সতর্ক। সাধারণত সকালে রুটি খেয়ে বেরোনোর পরে বিকেলে সামান্য মুড়ি ছাড়া আর কিছু খান না! একেবারে রাতে বাড়িতে ভাত। চারচাকা ‘ছোট হাতি’র পিঠে সওয়ার হয়ে এ দিন গোটা সকাল ভাঙড়ে প্রচারের পরে সামান্য ডাবের জলে ঠান্ডা হলেন সুজন। ফের বিকেল হতে না-হতেই তিনি হাজির যাদবপুর ৮বি বাসস্টপে। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী, তৃণমূলের সুগত বসুর প্রচার-গাইড অরূপ বিশ্বাস এ দিন প্রার্থীর সঙ্গে ঘুরে-টুরে, সোনারপুরে মুখ্যমন্ত্রীর সভাও আয়োজন করলেন। তার এক ফাঁকে বললেন, “সকালে পান্তাভাত খেয়ে বেরোচ্ছি বলেই এত খাটতে পারছি!”

উত্তর কলকাতার বিজেপি প্রার্থী রাহুল সিংহের বাড়তি পরিশ্রম। তিনি দলের রাজ্য সভাপতি। তাই গোটা রাজ্যেই ঘুরতে হচ্ছে। গত রাতে হেলিকপ্টারে তেল না-থাকায় জামশেদপুরে আটকে পড়েছিলেন। এ দিন সকালে সেখান থেকে কলকাতায় উড়ে এসে হাতিবাগান এলাকার কিছু মহল্লার দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। দুপুরে ফের এক প্রস্ত হেলিকপ্টার সফর। বিকেলে কলকাতায় নেমে বললেন, “কবে যে একটু বৃষ্টি হবে! মাটিতে-আকাশে কোত্থাও শান্তি নেই!”

এমন গুলিয়ে যাওয়া ভোটের অঙ্ক বৃষ্টি না নামলে যে মিলবে না, এটা বলতে বোধ হয় সুকুমার রায় হওয়ার দরকার নেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

riju basu hot
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE