পথচারীদের কথা ভেবে ব্যস্ত রাস্তা থেকে হকারদের তুলে দেওয়াই উচিত, যুক্তি দিয়ে এ কথা মানেন তাবড় রাজনৈতিক দলের নেতারা। কিন্তু হকারদের তুলে দিলে ভোটব্যাঙ্কে যে ঝড় উঠতে পারে, তার ঝুঁকি কোনও নেতাই ঘাড়ে নিতে নারাজ। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। কলকাতা শহরের কেন্দ্রস্থলে হকার নিয়ন্ত্রণের নামে ক্রমশই বেড়েছে তাঁদের রমরমা।
রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকাকেও হকার নিয়ন্ত্রণে অন্যতম বাধা বলে মনে করছেন রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা। নবান্নের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, “কেন্দ্রের নির্দেশিকা মেনে হকার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে ফুটপাথ তো পথচারীদের জন্য সাফ হবেই না, উল্টে শহর জুড়ে হকারদের দাপাদাপি অনেকটাই বেড়ে যাবে।” ওই কর্তার দাবি, কেন্দ্রের নীতিতে হকার নিয়ন্ত্রণে যে সব কমিটি তৈরির কথা বলা হয়েছে, তাতে মুখ্য ভূমিকায় থাকবেন হকারেরাই। তিনি বলেন, “এ ভাবে আর যা-ই হোক, হকার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।”
ইতিহাস উস্কে রাজ্য প্রশাসনের কর্তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এ রাজ্যে নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে এক বারই হকার নিয়ন্ত্রণে এবং পথচারীদের অধিকার রক্ষায় সদর্থক ভূমিকা নিয়েছিল সরকার। যা ‘অপারেশন সানশাইন’ হিসেবেই বহুল প্রচলিত। যে ঘটনাকে হকারদের পক্ষের শিবির ‘লজ্জাজনক’ এবং হকার-বিরোধী শিবির ‘গৌরবজনক’ আখ্যা দেয়। গৌরবজনক না লজ্জাজনক তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু প্রশাসনিক কর্তারা বলছেন, “ওই এক বারই রাজ্য সরকার রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার উর্ধ্বে উঠে হকার নিয়ন্ত্রণে রাস্তায় নেমেছিল।”
অপারেশন সানশাইনের অন্যতম মুখ, তদানীন্তন কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ এবং সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য হকার উচ্ছেদের বিরোধী। তিনি বলেন, “আমরা কখনওই হকার উচ্ছেদ করিনি। শহরের ২১টি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার ফুটপাথে পথচারীদের জন্য হাঁটাচলার ব্যবস্থা এবং হকারদের বিনাপয়সায় ঠিকঠাক পুনর্বাসন দিতে চেয়েছিলাম।” এ ধরনের কাজ থেকে রাজনীতি দূরে সরিয়ে রাখা উচিত বলেই মনে করেন কান্তিবাবু।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অপারেশন সানশাইন-এর সময়ে রাজ্য রাজনীতিতে বিরোধী নেত্রী ছিলেন। হকারদের অধিকার রক্ষায় সে সময়ে সরকার-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বও দেন তিনি। এখন তাঁর নেতৃত্বেই রাজ্য সরকার চলছে। স্বভাবতই হকারদের আশা, তাঁদের হিতের কথা মাথায় রেখেই হকার-নীতি গড়বেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য দিকে, রাস্তার ফুটপাথ পথচারীদের বদলে যাতে পুরোপুরি হকারদের দখলে না চলে যায়, তা-ও দেখার দায়িত্ব সরকারেরই। এই ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ দ্বন্দ্বের কারণেই হকার নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট কোনও নীতি আঁকড়ে রাজ্য সরকার এগোতে পারছে না বলেই রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের মত।
নগরোন্নয়ন দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ব্যক্তিগত ভাবে মুখ্যমন্ত্রী নিজে কিন্তু রাস্তা জুড়ে হকার দৌরাত্ম্যের ঘোরতর বিরোধী। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে তাঁর যাতায়াতের রাস্তায় হকার নেই বললেই চলে। আবার তাঁর নির্দেশেই এসএসকেএম হাসপাতাল চত্বর থেকে হকার তুলে দেওয়া হয়েছে।” ওই কর্তার দাবি, “কিন্তু শহরের অন্য জায়গায়, এমনকী সরকারি হাসপাতাল চত্বরে কিন্তু এমন হকার নিয়ন্ত্রণ চোখে পড়ে না।”
২০০৫-০৬ সাল নাগাদ কেন্দ্র প্রথম হকার নিয়ন্ত্রণে একটি নির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরি করে রাজ্যগুলিকে তার ভিত্তিতে মতামত দিতে বলে। কিন্তু বেশির ভাগ রাজ্যই তা নিয়ে কোনও মতামত দেয়নি। ইতিমধ্যে কেন্দ্রের হকার-নীতি বাস্তবায়নের দাবিতে বিভিন্ন হকার সংগঠন আদালতের দ্বারস্থ হয়। ২০০৯ সালে কেন্দ্র ফের হকার নীতির নির্দেশিকা পাঠিয়ে রাজ্যগুলিকে তার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট নীতি করতে বলে। কিন্তু সেই নীতিতে হকারদের স্বার্থের কথাই বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হয়েছে বলে দাবি প্রশাসনের কর্তাদের। ওই নির্দেশিকায় হকারেরা কোন রাস্তায় বসতে পারবেন বা পারবেন না, তা নির্দিষ্ট করা থেকে শুরু করে হকারদের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া ও হকার নিয়ন্ত্রণে পুরসভা-ভিত্তিক কমিটি তৈরি করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। হকার নিয়ন্ত্রণে তৈরি কমিটির ৪০% প্রতিনিধি হকারদের থেকে নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে নির্দেশিকায়।
রাজ্যের শীর্ষ কর্তারা প্রশ্ন তুলছেন, “কোথায় কত জন হকার বসবে, তা কীসের ভিত্তিতে ঠিক হবে? হকারদের রেজিস্ট্রেশন দেওয়ার মাপকাঠিই বা কী হবে? হকার-নীতি নির্ধারণে হকারদের কতটা গুরুত্ব দেওয়া হবে?”
এই সব প্রশ্নের কারণে বাম আমলের শেষের দিকে কেন্দ্রের নির্দেশিকা মেনে এমন একটি হকার নীতি তৈরি করার চেষ্টা হলেও তা চূড়ান্ত রূপ নেয়নি। বর্তমান সরকারের আমলেও বারংবার এই নিয়ে আলাপ-আলোচনা হলেও তা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। ফলে, কলকাতা শহরে হকার সমস্যা রয়ে গিয়েছে সেই তিমিরেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy