Advertisement
E-Paper

শহরের হৃদয়ে রহস্য অপার

কলকাতার মধ্যে থাকে আর একটা কলকাতা! ভোটের সময় তার দেখা মেলে। দোল-দুর্গোৎসব-ঈদ-বড়দিনের মতোই ভোটও এক উৎসব। পদযাত্রার শব্দে সকাল হয়। সন্ধেবেলায় চতুর্দিকে ছোট-বড়-মাঝারি নানা মাপের, নানা রঙের মঞ্চ আর মাইকের আওয়াজ যেন রবীন্দ্রজয়ন্তীর কোনও নতুন অবতার! শহরটাও সাজে। এত দিন শুধু তেরঙ্গা এবং লালে শহরের আকাশরেখা ঢেকে যেত। এ বার শূন্যের দখল নিতে গেরুয়ারও জবরদস্ত উপস্থিতি।

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৪ ০৩:১৭

কলকাতার মধ্যে থাকে আর একটা কলকাতা! ভোটের সময় তার দেখা মেলে।

দোল-দুর্গোৎসব-ঈদ-বড়দিনের মতোই ভোটও এক উৎসব। পদযাত্রার শব্দে সকাল হয়। সন্ধেবেলায় চতুর্দিকে ছোট-বড়-মাঝারি নানা মাপের, নানা রঙের মঞ্চ আর মাইকের আওয়াজ যেন রবীন্দ্রজয়ন্তীর কোনও নতুন অবতার!

শহরটাও সাজে। এত দিন শুধু তেরঙ্গা এবং লালে শহরের আকাশরেখা ঢেকে যেত। এ বার শূন্যের দখল নিতে গেরুয়ারও জবরদস্ত উপস্থিতি। পাড়ায় পাড়ায়, গলির মোড়ে, বাড়ির রকে, চায়ের দোকানের তর্কযুদ্ধে মোদী মধ্যমণি। তাঁর পক্ষে বলুন, বা বিপক্ষে নরেন্দ্র মোদীকে এড়ানো অসম্ভব।

এত দিন রাজ্যের সীমান্তবর্তী দু-চারটি এলাকায় বিজেপি-র উত্থান সম্পর্কে কিছু আলোচনা শোনা যেত। এ বার ভোটে সেটাই রাজ্যব্যাপী, ফলে কলকাতাতেও সংক্রমিত। এতটাই যে, শহরের দুই কেন্দ্রে পদ্মের ঘায়ে জোড়া ফুলের মূর্ছা যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বাজি ধরার লোকও কম জুটছে না!

শহরের জনমত সব সময়ই সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিত বিচার করে। তাই এটা লোকসভার ভোট হলেও রাজ্যে তিন বছরের তৃণমূল সরকারের বিবিধ কাজকর্মের মূল্যায়ন থেমে নেই। সেখানে পার্ক স্ট্রিট থেকে কামদুনি, অনুব্রত থেকে আরাবুল, রায়গঞ্জে অধ্যক্ষ নিগ্রহ থেকে গার্ডেনরিচে কলেজ নির্বাচন ঘিরে সমাজবিরোধী তাণ্ডব এবং পুলিশ অফিসারের মৃত্যু পর্যন্ত কোনও কিছুই বাদ যায় না। একেবারে শেষবেলায় সারদা-কাণ্ডের সিবিআই তদন্ত হওয়ার খবরেও মধ্যবিত্ত বাঙালি মন আলোড়িত। অনেক প্রশ্ন, অনেক সংশয়, অনেক বিস্ময়। হয়তো কিছুটা ধাক্কাও। অনেকের মতে, এ সব অনেক কিছুই বিজেপি সম্পর্কে আগ্রহ বৃদ্ধির উপাদান।

যে কোনও পুরনো শহরের মতো কলকাতারও উত্তর এবং দক্ষিণ চরিত্রে কিছুটা আলাদা। উত্তর পুরনো, দক্ষিণ জমে উঠেছে পরে। উত্তরে বনেদিয়ানা বেশি, খাস কলকাতার শিকড় সেখানে অনেক গভীরে। দক্ষিণে ওপার থেকে আসা মানুষ আছেন প্রচুর, যাঁরা কালক্রমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। উত্তরে বস্তি বেশি, দক্ষিণে কলোনি। কাশীপুর-চিৎপুর-কলুটোলা-রাজাবাজার-বাগমারি-এন্টালিতে ছড়িয়ে থাকা সংখ্যালঘুদের সংখ্যা উত্তর কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে নেহাত কম নয়। দক্ষিণ কলকাতা কেন্দ্রেও গার্ডেনরিচ-খিদিরপুর-তপসিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় সংখ্যালঘুদের ঘন বসবাস। এর পাশাপাশি শহরের বড় অংশ জুড়ে আছেন অবাঙালি, মূলত হিন্দিভাষী, ব্যবসায়ী ভোটারকুল। শহর জুড়ে প্রোমোটারির রমরমায় উত্তরের জোড়াসাঁকো-বড়বাজার ছাড়িয়ে এই অবাঙালি ব্যবসায়ীরা ছড়িয়ে পড়েছেন কাঁকুড়গাছি, ফুলবাগান-সহ নানা বর্ধিষ্ণু পাড়ায়। দক্ষিণেও এঁদের বিস্তার আলিপুর, নিউ আলিপুর, বালিগঞ্জের বিভিন্ন অভিজাত অঞ্চলে। অনেকের মতে, খাস কলকাতার প্রায় অর্ধেকই এখন এঁদের ঠিকানা। এক নজরে জনবিন্যাসের এমন একটি ছবি থেকে ধরে নেওয়া যায়, সাবেক ভোটার ছাড়াও অবাঙালি ব্যবসায়ী এবং সংখ্যালঘু ভোটারদের রায়ের উপর কলকাতার দুই কেন্দ্রের নির্বাচনী ফল অনেকটাই নির্ভরশীল।

গত বিধানসভা নির্বাচনে সব ভোট চেঁছেমুছে নিজের ঘরে তুলতে পেরেছিল তৃণমূল। গোটা কলকাতায় সব বিধায়ক এখন তাদের। কিন্তু এ বার পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। অবাঙালি ব্যবসায়ীদের ভোটের সিংহভাগ যদি বিজেপির দিকে যায়, তা হলে তৃণমূলের বড় ভরসাস্থল সংখ্যালঘুরা। সেখানেও ভাগ নিতে তৈরি কংগ্রেস এবং সিপিএম। বিশেষত উত্তর কলকাতা কেন্দ্রে এই হিসেব জরুরি। কারণ দক্ষিণের তুলনায় অবাঙালি ও সংখ্যালঘু, দুই ভোটই উত্তরে কিছু বেশি।

বড়বাজারের কিছু এলাকায় বিজেপির প্রভাব এর আগেও দেখা গিয়েছে। পুর-নির্বাচনেও এখান থেকে বিজেপি প্রার্থীরা জিতেছেন। কিন্তু এ বার তাদের নিবিড় অবস্থান জোড়াসাঁকো-বড়বাজারের অলিগলিতে। গেরুয়া পতাকায় ছেয়ে গিয়েছে সব মহল্লা। গণেশ সিংহানিয়া, রাজকুমার অগ্রবাল, অনিল কয়ালরা এগিয়ে এসে বলেছেন, দেশে তাঁরা ‘মোদী কা সরকার’ চান। দলের রাজ্য সভাপতি এবং কলকাতা উত্তরের বিজেপি প্রার্থী রাহুল সিংহ বুক ঠুকে দাবি করেছেন, “একটি ভোটও এ বার বিজেপির বাইরে যাবে না।”

উত্তরের এই কেন্দ্রে তিন বার জেতা তৃণমূল প্রার্থী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় অভিজ্ঞ রাজনীতিক, মনোযোগী সাংসদ। এই কেন্দ্র থেকে জিতেই তিনি লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা হন। আবার এখানেই এক বার বিক্ষুব্ধ তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে তৃণমূল প্রার্থীর পরাজয় নিশ্চিত করে তিনি নিজের ‘ক্ষমতা’ প্রমাণ করেছেন। নিজের কেন্দ্রটিকে তিনি ‘হাতের তেলোর মতো’ চেনেন বললে সেই দাবিকেও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া অনুচিত। তাঁর এক একটি পদযাত্রার আকার-আয়তন যে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীর ঈর্ষা বা শঙ্কার কারণ হতে পারে। তবু অভিজ্ঞতার আলোয় তিনিও বিজেপির বৃদ্ধি অস্বীকার করেননি।

যদিও তাঁর যুক্তি, “এই লোকসভা কেন্দ্রে সাত জন বিধায়ক এবং ৬০টির মধ্যে ৩৮টি পুর-ওয়ার্ড তৃণমূলের। নিজ নিজ এলাকার কাউন্সিলর এবং এমএলএ-রা তাঁদের দায়িত্বেই দলীয় প্রার্থীকে জেতাবেন। তাই বিজেপির ভোট কিছুটা বাড়লেও আমার চিন্তা নেই। তা ছাড়া বিজেপি তো সিপিএমের ভোটও কাটবে।”

বিজেপি যে এ বার সিপিএমের একাংশের ভোট পেতে চলেছে, তেমন দাবি দলের রাজ্য সভাপতি রাহুলবাবুরও। তাঁর বক্তব্য, “সিপিএমের অনেকে এসে বলছে, বিজেপি জিতলে অন্তত গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু থাকবে। তৃণমূলের হাতে সেটাও নেই। তাই আমরা এ বার বিজেপি-কেই ভোট দেব।” স্বাভাবিক ভাবেই সিপিএমের তরফে এই ব্যাখ্যার কোনও সমর্থন মেলার কথা নয়।

সংখ্যালঘুরা অবশ্য প্রকাশ্যে তৃণমূলের পক্ষেই কথা বলছেন। নাখোদা মসজিদের কাছে জুতোর ব্যবসায়ী হাজি তামিজুল হক, হাজি মহম্মদ মহসিন, হাজি শওকতের মতো অনেকেই এ বিষয়ে তাঁদের মতামত জানাতে অকপট। তাঁরা তৃণমূলের পক্ষে অ-রাজনৈতিক প্রচারপত্রও বিলি করছেন। তবু সিপিএমের রূপা বাগচী এবং তৃণমূল-ত্যাগী কংগ্রেস প্রার্থী সোমেন মিত্র মুসলিম ভোট একেবারে পাবেন না, ভাবা ঠিক নয়। তৃণমূলের হাত ছাড়ার পরে সাবেক উত্তর কলকাতায় কংগ্রেসের নিজস্ব ভোট কতটা আছে, এক সময়ের কংগ্রেস হেভিওয়েট সোমেনবাবুকে শিখণ্ডী করে তারও একটা পরীক্ষা হবে এ বার।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খাসতালুক দক্ষিণে পরিস্থিতি আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা হলেও ভিন্ন। লোকে বলে, রাজ্যের ৪২টি কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থীদের নামের আড়ালে যদি এক জন করে ‘মমতা’ লড়েন, কলকাতা দক্ষিণে তবে একসঙ্গে ৪২টি মমতার প্রকাশ। যার সোজা কথা, এই কেন্দ্র মমতায় মাখামাখি। তৃণমূলের ঘোর দুর্দিনেও একা মমতাকে দিল্লি পাঠিয়েছে কলকাতা দক্ষিণ।

বিজেপির হাওয়া এ বার এখানেও বইছে। তবে তা বড়বাজারের মতো উতল নয়। হয়তো তাই বিজেপি প্রার্থী তথাগত রায় প্রচারের তুঙ্গ সময়েও সন্ধেবেলায় টিভি চ্যানেলে বসার সময়-সুযোগ পেয়েছেন। সিপিএমের নন্দিনী মুখোপাধ্যায় তাঁর দলের সাংগঠনিক শক্তিতে ভর করে যথেষ্ট ঘুরেছেন। আর তৃণমূলে মমতার এক সময়ের ঘনিষ্ঠ কাউন্সিলর মালা রায়কে প্রার্থী করে কংগ্রেস কিছুটা চমক দেখানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু বাস্তব বড় কঠোর!

মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য সুব্রত বক্সীকে পদত্যাগ করিয়ে লোকসভায় নিজের শূন্য আসনের উপনির্বাচনে জিতিয়ে নিয়ে যান তিন বছর আগে।

সাংসদ হিসেবে তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি ‘বক্সীদা’ কতটা দাগ কেটেছেন, তা বিতর্কের বিষয়। তবে মমতার আশীর্বাদের হাত মাথায় থাকলে অশক্তও দক্ষিণ কলকাতা লোকসভার ‘পাহাড়’ পেরোতে পারে, এই ধারণা খুব একটা বদলায়নি। প্রচারের শেষ লগ্নে দক্ষিণ কলকাতা ভেদ করে মমতার বিশাল মিছিলে সেটা বরং আরও বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।

তবে তিলোত্তমা বড়ই রহস্যময়ী! গোপন কথা সে গোপনে রেখে দিয়েছে কি না, কে বলবে!

calcutta election debashis bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy