Advertisement
১৬ মে ২০২৪

সুগন্ধের স্মৃতিবিলাস

বুলবুলি-লড়াই, লক্কা পায়রা, গিলে করা পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি...বাঙালি সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়ার তালিকায় ঢুকে গিয়েছে আতরও। বাবুবিলাসের নিশি ফুরনোর সঙ্গে সঙ্গেই যেন খাঁটি আতরদানও শূন্য হয়ে গেল। হবে নাই বা কেন? রবীন্দ্র সরণির নাখোদা মসজিদ অঞ্চলে যে চার-পাঁচটি দোকান আজ বেশির ভাগ সস্তা আতর বিক্রি করেন, তাঁরাই জানাচ্ছেন, বেশি দামের জন্যই ভাল আতরের বিক্রি এখন প্রায় নেই।

রবীন্দ্র সরণির একটি দোকানে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

রবীন্দ্র সরণির একটি দোকানে। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৪ ০৫:৪৩
Share: Save:

সে বাবুও নেই, সে বিলাসও নেই।

বুলবুলি-লড়াই, লক্কা পায়রা, গিলে করা পাঞ্জাবি আর কোঁচানো ধুতি...বাঙালি সংস্কৃতির হারিয়ে যাওয়ার তালিকায় ঢুকে গিয়েছে আতরও। বাবুবিলাসের নিশি ফুরনোর সঙ্গে সঙ্গেই যেন খাঁটি আতরদানও শূন্য হয়ে গেল।

হবে নাই বা কেন? রবীন্দ্র সরণির নাখোদা মসজিদ অঞ্চলে যে চার-পাঁচটি দোকান আজ বেশির ভাগ সস্তা আতর বিক্রি করেন, তাঁরাই জানাচ্ছেন, বেশি দামের জন্যই ভাল আতরের বিক্রি এখন প্রায় নেই। তা ছাড়া বিদেশি সুগন্ধি অনেকটাই নিয়ে নিয়েছে আতরের বাজার। ১৮২৪-এ স্থাপিত হাজি খুদা বক্স নবি বক্স পারফিউমার্স-এর নেয়াজউদ্দিন আল্লা বক্স ও সাফিকুদ্দিন আল্লা বক্স বললেন, “বেশির ভাগ ক্রেতা ১০০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে এক শিশি আতর কিনতে চান। খাস আতরের ‘বেস’ হল চন্দন তেল। যা এখন দুর্মূল্য। ১০ গ্রাম আসল আতরের দাম পড়তে পারে ৪০০ থেকে শুরু করে ৪০০০ টাকার মধ্যে। ফলে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ‘ঊদ’, ‘খস’, ‘হায়াতি’, ‘মুস্ক’, ‘মজমুয়া’, ‘শ্যামামা’ কিংবা ‘গুলাব’-এর মতো দামি আতর।”

নেয়াজউদ্দিন আরও জানালেন, বাজারে চলছে নতুন এক ধরনের সুগন্ধি। একে বলে সিন্থেটিক আতর। এর গন্ধ দামি পারফিউমের মতো। আর নতুন প্রজন্মের পছন্দ এই সিন্থেটিক আতর। ১৪০ বছরের পুরনো রবীন্দ্র সরণির তাজ সুর্মা ও আতর স্টোর্সের জামালুদ্দিন বললেন, “আতরের ব্যবসা মরসুমি। ঐতিহ্যকে ধরে রাখতেই ঈদ, দোল, দুর্গাপুজো, দেওয়ালি ও বিবাহ উপলক্ষে কিছু মানুষ আতর ব্যবহার করেন। তবে আসল আতরের ক্রেতা দিনে দিনে কমছে।”

তবু, আম আদমির এই আতরের পাশে আজও খাস আতর কেনেন কিছু রাজা ও জমিদারের বংশধরেরা। শোভাবাজার রাজপরিবারের বড় তরফের রথীন্দ্রনারায়ণ দেব বললেন, “আজও ‘খস’, ‘গোলাপ’ কিংবা ‘মালতীর’ আতর ব্যবহার করতে ভাল লাগে। যদিও আতরের মান আগের তুলনায় পড়ে গিয়েছে। আগে আতর হত গাঢ়, এখন সেটা পাতলা। সেই কারণেই গন্ধ বেশিক্ষণ থাকে না। একটা জিনিস লক্ষ করেছি, পুজোর সময় বাড়ির সামনের রাস্তায় দু’জন আতরওয়ালা বসেন। যাঁরা শোভাবাজার রাজবাড়িতে ঠাকুর দেখতে আসেন তাঁদের অনেকেই ফ্যাশন করে এক শিশি আতর কেনেন। তবে আদৌ কী সেটা ব্যবহার করেন? উত্তর কলকাতার পরিচিত চরিত্রটা যেমন বদলে যাচ্ছে ঠিক তেমনই বদলে যাচ্ছে আতরের চরিত্রটা।”

মুক্তরামবাবু স্ট্রিটের মার্বেল প্যালেসের হীরেন্দ্র মল্লিক বললেন, “আসল আতর আসে লখনউ, কণৌজ এবং হায়দরাবাদ থেকে। এক ভরি ‘খস’, ‘রুহি’, কিংবা ‘জ্যাসমিন’ আতরের দাম দু’হাজার থেকে চার হাজার টাকার মধ্যে। তবে এ শহরের চিৎপুর, বড়বাজার ও পার্কসার্কাসের কিছু দোকানে পাওয়া যায় খাস আতর।” আতরের কথা বলতে বলতে হীরেন্দ্রবাবু অতীতে ডুব দিলেন। তিনি জানালেন, রাগসঙ্গীতে যেমন ভাগ করা আছে দিনের কোন সময়ের কোন রাগ, ঠিক তেমনই দিনের বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করা হত আলাদা আলাদা আতর। তা ছাড়া বিভিন্ন ঋ

তুর আলাদা আতর তো আছেই। শুধু তাই নয় এক এক রকম পোশাকের সঙ্গে চলত এক এক রকম আতর।

লখনউর নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ এবং মাড়োয়াড়ি সম্প্রদায় কলকাতায় আসার পরে বেড়েছিল আতরের ব্যবহার ও ব্যবসা। সকলেই জানেন যে ওয়াইন যত পুরনো হয় তার দাম তত বাড়ে, কিন্তু এটা অনেকেরই অজানা যে ‘খস’ আতর যত পুরনো হয় তার মূল্যও তত বেড়ে যায়।”

পুরনো চাল ভাতে বাড়ে, পুরনো আতর কেবল স্মৃতিতে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

perfume
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE