Advertisement
০৫ মে ২০২৪

স্মৃতির সরণি বেয়ে তোমার কাছে

সে অনেক দিন আগের কথা। ইংরেজ রাজত্বকাল। আমার বাবার তখন ১২ বছর বয়স। ঠাকুর্দা কর্মসূত্রে কলকাতায় আসতেন। এক বার খবর পেলেন ভাগ হতে চলেছে দুই বাংলা। পরিবার নিয়ে তিনি চলে এলেন কলকাতায়। নতুন করে জীবন শুরু করলেন। আমগ্রামের এত দিনের সংসার ছেড়ে নতুন করে বাসা বাঁধলেন কালীঘাটের ছোট্ট বাড়িতে। আমার মা আবার কলকাতায় এসেছিলেন সেই সুদূর বার্মা মুলুক থেকে। তিনি তখন খুবই ছোট, এক কি দেড় বছর বয়স হবে! সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল। পারিবারিক কারণেই সেই সময় থেকেই আমার কলকাতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য নাড়ির টান।

সুপর্ণা চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

সে অনেক দিন আগের কথা। ইংরেজ রাজত্বকাল। আমার বাবার তখন ১২ বছর বয়স। ঠাকুর্দা কর্মসূত্রে কলকাতায় আসতেন। এক বার খবর পেলেন ভাগ হতে চলেছে দুই বাংলা। পরিবার নিয়ে তিনি চলে এলেন কলকাতায়। নতুন করে জীবন শুরু করলেন। আমগ্রামের এত দিনের সংসার ছেড়ে নতুন করে বাসা বাঁধলেন কালীঘাটের ছোট্ট বাড়িতে। আমার মা আবার কলকাতায় এসেছিলেন সেই সুদূর বার্মা মুলুক থেকে। তিনি তখন খুবই ছোট, এক কি দেড় বছর বয়স হবে! সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল। পারিবারিক কারণেই সেই সময় থেকেই আমার কলকাতার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য নাড়ির টান।

বাবার জন্ম পটনায়। পরের দিকে তাঁকে ভর্তি করা হয় ফরিদপুরের স্কুলে। হিন্দি ভাষায় তাই তিনি ছিলেন অনায়াস। মা যদিও বাংলা ছাড়া আর কোনও ভাষাই জানতেন না। সত্তরের দশকে আমি যখন ভবানীপুরে বড় হচ্ছি, তখন ট্যাক্সিচালক মানেই পঞ্জাবি। ট্যাক্সি চড়ে কোথাও যাওয়ার সময়, বাবার অনুপস্থিতিতে, মা সেই সব চালকদের সঙ্গে বাংলাতেই কথা বলতেন। কিন্তু বাক্যের শেষের শব্দগুলিতে অদ্ভুত ভাবে তিনি ‘ইঙ্গে’ বা ‘আঙ্গে’ জুড়ে দিতেন। হিন্দির কাছাকাছি পৌঁছনোর জন্য এটাই ছিল ওঁর কাছে সহজ উপায়। একই রকম ভাবে তিনি অবাঙালি ফেরিওয়ালাদের বলতেন, ‘তোমার ডিম কিতনা করেঙ্গে?’ কিংবা অবাঙালি অতিথিদের জিজ্ঞেস করতেন, ‘চা খায়েঙ্গে?’ মায়ের এমন অদ্ভুত প্রয়াসে সাড়া দিয়ে অনেক ট্যাক্সিচালককে হেসে উঠে বলতে শুনেছি, ‘মা, আমি বাংলা বলতে পারি। বুঝতেও পারি।’ এ যেন শহর কলকাতার এক আজব আবদার তার সকল নাগরিকের উপর। যার কারণে, অন্য ভাষাভাষীর মানুষেরাও এই শহরের ভাষা আয়ত্ব করে নেন বেশ সহজে।

ট্রাম, বাস, হাতেটানা রিকশা, ঠেলা, সাইকেল, হরিশ পার্ক, আমাদের ইটপাতা গলি, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, রাস্তাজোড়া মিছিল, মিষ্টির দোকান, ভারতী পাঠাগার, পুরনো সব বাড়ি আর সেই সব বাড়ির ফাঁকে-ফোঁকড়ে বেড়ে ওঠা বট-অশ্বত্থের চারা, বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে আকাশজোড়া ঘুড়ির চাদর, কাচেরগুঁড়ো দিয়ে সুতোর মাঞ্জা, উজ্জ্বলা চানাচুর, মামার দোকানের চপ, জগুবাবুর বাজার, বেল কুঁড়ির মালা, রজনীগন্ধার স্টিক— কলকাতা শব্দের সঙ্গে এগুলো যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় আমার মনে। মনে আছে আমাদের বাড়ির লোহার গরাদ দেওয়া জানলাটার কথা। সেই গরাদের ও পারে আটকে থাকা বাইরের জগৎ আজও আমায় টানে। গরমকালের নিস্তব্ধ দুপুরে সেই জগৎ থেকে ভেসে আসত ফেরিওয়ালার হাঁক, ‘মালাই চপ।’ কেমন সেই চপ? জানার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু মা বলতেন, ‘ও সব খাবার কলেরা-সহ নানা রোগের ডিপো।’ ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের মিনির মায়ের সঙ্গে আমার মা কোনও এক জন্মে বোধহয় সই পাতিয়েছিলেন। না হলে দু’জনের এত মিল কী করে হয়! দুনিয়ার সব ব্যাকটেরিয়া যেন আমার শরীরে ঢুকবে বলে ওঁত পেতে বসে থাকে!

দক্ষিণ কলকাতার সঙ্গে আমার পরিচয় ইস্কুল আর কলেজের হাত ধরে। বেশ মনে আছে, গড়িয়াহাটের চৈত্র সেলের কথা। বড়রা বলতেন, ‘ওই জামাকাপড় এক্কেবারেই টেকসই হয় না।’ তবু ব্যাগ ভর্তি করে সেল-সামগ্রী আসত বাড়িতে। আমাদের সে সব নিয়ে থাকত টইটুম্বুর উত্তেজনা! তখন কলেজে পড়ি। মায়ের শাসনে বাইরের খাবারের উপর ছিল কড়া নিষেধাজ্ঞা। তবু এক দিন বন্ধুদের সঙ্গে গেলাম ফুচকা খেতে। বাসন্তীদেবী কলেজের সামনের ফুচকাওয়ালার নাকি শহরজোড়া নামডাক। তাঁর ফুচকা খাইনি শুনে বন্ধুদের ছিল অবাক হওয়া, আর আমার তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল লজ্জা। মনে পড়ে, বন্ধুরা দলবেঁধে গিয়েছিলাম প্রেমা ভিলাসে দোসা খেতে। অবাক চোখে দেখেছিলাম, প্লেট ছাড়িয়ে দোসা নিয়ে আসছেন ওয়েটার। বাড়ির বাইরে খাওয়ার হাতেখড়ি শুরু হল আমার। বাদশা-র রোল, কিংবা ফ্রসটি বা ধাবা থেকে চিকেন রোল— এখনও মুখে লেগে আছে যেন! এর আগে সব গল্পই মাকে বলতাম হইহই করে। কিন্তু শহরটাকে যখন বন্ধুদের সঙ্গে রঙিন চশমা পরে একটু একটু করে চিনছি, তখন দরকার মতো সেন্সরের কাঁচি পড়তে থাকল মায়ের কাছে রোজনামতার গল্পে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি, উত্তর কলকাতা এবং তার সাবেকি আমেজের সঙ্গে তখন পরিচয় হল। উপচে পড়া ভিড় আর এঁকেবেঁকে এগোনো সরু রাস্তা। এমএ পড়ার সময়েই সাতপাকে বাঁধা পড়লাম। ব্যস! সেই সূত্র ধরেই আমার কলকাতা ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি। যত সময় কলকাতায় কেটেছে, প্রায় ততটা সময় কাটিয়েছি প্রবাসের মাটিতে। তবু কলকাতাকে নতুন করে কাছে পেতে প্রতি বছর যাই, জন্মসূত্রের টানে। আগের সেই আমেজ আজ চাপা পড়ে গিয়েছে শপিং সেন্টারের ভিড়ে। তবু যাই গড়িয়াহাটে মার্কেটে। মনে ভিড় করে আসে আমার মেয়েবেলার অনেক স্মৃতি। নিউমার্কেটে পৌঁছলে এখনও একটা চাপা উত্তেজনা টের পাই। কত রকম কেনাকাটি করতাম এখানে মায়ের সঙ্গে। হগ মার্কেটের সেই বড় কামানটা আর নেই। বাড়িতে গেলে মা বলেন, ‘এমা! বড়ুয়ার কেক আনলি? এখন তো আর এ সব চলে না!’ শহরটা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। একই গতিতে আমিও ছুটে ছুটে যাই ফেলে আসা স্মৃতির ভিড়ে আটকে পড়া জায়গাগুলিতে। গড়িয়াহাটের বাজার বা নিউমার্কেট, কিন্তু তাতে আমার ছেলেদের মন ওঠে না। তারা ভিড় ঠেলে চলতে আনন্দ পায় না। আমি তাদের চোখে চোখ রেখে খুঁজে চলি সেই শহরটাকে। যার সঙ্গে আমার নাড়ির টান। এত দেখি তবু তো শেষ হয় না দেখতে চাওয়ার।

—নিজস্ব চিত্র।

জন্মসূত্রে কলকাত্তাইয়া। বিবাহের সুবাদে অস্ট্রেলিয়ার পারথ শহরের বাসিন্দা। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। স্বামী-সন্তান-চাকরি নিয়ে প্রবাসের সংসার। আছে লেখালেখির নেশা। দীর্ঘ দিন গল্প লেখার পর সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে প্রথম উপন্যাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE