Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
আরপুলি লেন

সরকারি পরিকাঠামোর ছিদ্রপথে গ্যাস-আতঙ্ক

আরপুলি লেনের বাসিন্দারা বলছেন, ওই এলাকায় বহু দিন ধরেই পাইপলাইন রয়েছে। এক সময় অনেক বাড়িতেই এই সংস্থার কোল-গ্যাস ব্যবহার করা হত। এখন বেশির ভাগ এলপিজি ব্যবহার করেন। ওই এলাকায় হাতেগোনা কয়েকটি বাড়িতে এখনও কোল গ্যাসের গ্রাহক আছেন। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের কাজ একেবারে হয় না বলে অভিযোগ।

আতঙ্কে এলাকা ছাড়ছেন অন্য পেয়িং গেস্টরা। রবিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

আতঙ্কে এলাকা ছাড়ছেন অন্য পেয়িং গেস্টরা। রবিবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

কুন্তক চট্টোপাধ্যায় ও বিদীপ্তা বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:৫৬
Share: Save:

এ যেন ঐতিহ্যকে বয়ে বেড়ানো! কিংবা নিধিরাম সর্দার দিয়ে যুদ্ধে লড়া!

আরপুলি লেনে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সুমন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু তুলে দিয়েছে ফের একটি চিরাচরিত প্রশ্ন, বেহাল পরিকাঠামো দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পরিষেবা দেওয়া। এখানে প্রশ্নের মুখে পড়েছে গ্রেটার ক্যালকাটা গ্যাস সাপ্লাই কর্পোরেশন। গ্যাস সাপ্লাই কর্পোরেশন সূত্রের খবর, প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো এই সংস্থার কর্মী সংখ্যা বর্তমানে শ’তিনেক। কলকাতা, হাওড়া এবং রিষড়া মিলিয়ে গৃহস্থ গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। বাণিজ্যিক গ্রাহকের হিসেব ধরলে সংখ্যাটা অনেকটাই বেশি!

আরপুলি লেনের বাসিন্দারা বলছেন, ওই এলাকায় বহু দিন ধরেই পাইপলাইন রয়েছে। এক সময় অনেক বাড়িতেই এই সংস্থার কোল-গ্যাস ব্যবহার করা হত। এখন বেশির ভাগ এলপিজি ব্যবহার করেন। ওই এলাকায় হাতেগোনা কয়েকটি বাড়িতে এখনও কোল গ্যাসের গ্রাহক আছেন। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের কাজ একেবারে হয় না বলে অভিযোগ।

৪ জানুয়ারি কলেজ স্ট্রিট এলাকার আরপুলি লেনের একটি বাড়ির একতলার ঘর থেকে সুমন্তিকার প্রাণহীন দেহ উদ্ধার করা হয়। সে সময় ঘর থেকে তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ পেয়েছিলেন তদন্তকারীরা। সেই ঝাঁঝালো গন্ধের উৎস খুঁজতে গিয়েই শনিবার ধরা পড়ে, সুমন্তিকার ঘরের জানলা ঘেঁষে, মাটির ৮০ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে যাওয়া গ্যাস সাপ্লাই কর্পোরেশনের পাইপলাইনে ৪ ইঞ্চি লম্বা একটি ফাটল রয়েছে।

পুলিশ বলছে, গ্যাস সাপ্লাই কর্পোরেশনের পাইপের ফাটলের সঙ্গে সুমন্তিকার মৃত্যুর সরাসরি সম্পর্ক এখনও প্রমাণ হয়নি। তবে ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে ঘুমের মধ্যে শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। ঘরের মধ্যে তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ মিলেছিল। তাই বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সুমন্তিকার মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্ক মিলুক বা না-মিলুক, গ্যাস পাইপলাইনের রক্ষণাবেক্ষণ যে প্রয়োজন, তা অবশ্য এক বাক্যে মেনে নিয়েছেন অনেকেই। কারণ, কোল গ্যাস অত্যন্ত দাহ্য একটি গ্যাস। এর মূল উপাদান কার্বন মনোক্সাইড। তার সঙ্গে থাকে হাইড্রোজেন ও মিথেনও। গ্যাস সংস্থা ও রসায়ন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খোলা জায়গায় এই গ্যাস স্বাস্থ্যের জন্য ততটা ক্ষতিকর নয়। কিন্তু বদ্ধ জায়গায় এই গ্যাস মারাত্মক হতে পারে। একই কথা বলছে সংস্থাও। নিজেদের ওয়েবসাইটে নিরাপত্তা সংক্রান্ত উপদেশে তারা বলেছে, “রান্নাঘরে এই গ্যাস কেউ বেশি ক্ষণ ধরে শুঁকে ফেললে তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যান।” এবং এই প্রসঙ্গেই পাইপলাইনের রক্ষণাবেক্ষণ প্রাসঙ্গিক।

বস্তুত, কলকাতার পুরনো বাসিন্দারা সেই রক্ষণাবেক্ষণের ছবির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ইতিহাস বলছে, ব্রিটিশ আমলে শহরের গৃহস্থ বাড়িতে রান্নার গ্যাসের জন্য পাইপ পেতেছিল ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানি। নানা বদলের পর এক সময় তা-ই হয়ে দাঁড়ায় গ্রেটার ক্যালকাটা গ্যাস সাপ্লাই কর্পোরেশন। সংস্থার ওয়েবসাইট বলছে, বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই এই সংস্থা শুরু করা হয়েছিল। পাইপলাইনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণও করতেন কর্মীরা। আরপুলি লেনের বাসিন্দা সিদ্ধার্থ সরকার বলছেন, “ছোটবেলায় দেখতাম গ্যাস সাপ্লাইয়ের লোক এসে পাইপলাইনে মেরামতির কাজ করত।” কিন্তু এলপিজির প্রচলন হওয়ায় এই গ্যাসের ব্যবহারকারী কমেছে। অনেকেই বলছেন, সংস্থার পরিষেবা খারাপ হয়েছে। তাই কোল গ্যাসের লাইন ছেড়ে দিয়েছেন। কেউ কেউ কোল গ্যাসের লাইন থাকা সত্ত্বেও এলপিজি ব্যবহার করেন।

তেমনই এক জন দেবাশিস লাহা। বাড়িতে কোল গ্যাস থাকা সত্ত্বেও এলপিজি নিয়েছেন। পরিষেবা নিয়ে সন্তুষ্ট নন দেবাশিসবাবু। তিনি বলছেন, “গ্যাস লাইনে গোলযোগের খবর দিলে কর্মীরা আসেন। কিন্তু নিয়ম করে রক্ষণাবেক্ষণ হয় না।” অনেকেই বলছেন, বাড়ির পাইপে ফাটল হলে গ্রাহক বুঝতে পারবেন। কিন্তু মাটির তলায় ফাটল চট করে বোঝা সম্ভব নয়। “সুমন্তিকার মৃত্যু নিয়ে হইচই না হলে এই পাইপের ফাটল ধরা পড়ত কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।” বলছেন এলাকার এক বাসিন্দা। এই পরিস্থিতিতে কোল গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা রাখা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এলাকার বাসিন্দা এবং স্থানীয় কাউন্সিলর সত্যেন্দ্রনাথ দে বলছেন, “পরিষেবা না দিতে পারলে এই গ্যাস দেওয়ার মানে কী!”

রক্ষণাবেক্ষণের ফাঁক বেরিয়ে আসায় কিছুটা আতঙ্কিত এলাকার বাসিন্দারাও। এ দিন বিকেলেই তিন তরুণীকে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে। তাঁরা জানান, সুমন্তিকার মতোই ওই এলাকায় পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকতেন। এ দিন অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছেন। এর থেকে বেশি কিছু বলতে চাননি তাঁরা। তবে পেয়িং গেস্টদের আতঙ্কের কথা স্বীকার করেছেন সুমন্তিকার ভাড়াবাড়ির মালকিন রমা চৌধুরী। তাঁর বাড়ির একতলায় আরও কয়েক জন পেয়িং গেস্ট রয়েছেন। রমাদেবী বলেন, “অনেক ছাত্রীই আতঙ্কিত। আমি সবাইকে বলেছি, অন্যত্র বাড়ি দেখে উঠে যাও। আমি নিজেও আতঙ্কিত।”

পরিষেবা যে দেওয়া যাচ্ছে না, তা স্বীকার করেছেন সংস্থার বহু কর্মীই। তাঁরা বলছেন, বহু দিন নিয়োগ বন্ধ। কর্মী এত কম যে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হয় না। শীর্ষ স্তর থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী না হলে সংস্থা টিঁকিয়ে রাখা কতটা সম্ভব, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। এ ব্যাপারে সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার প্রশান্ত চৌধুরীকে ফোন করা হলে তাঁর মোবাইল ফোন বন্ধ মেলে। সংস্থার এমডি রাজীব কুমার ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও উত্তর দেননি তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE