Advertisement
E-Paper

ফের রক্তাক্ত বাম মিছিল, শহরের রাস্তায় নেমে মার খেলেন নেতারাও

নবান্নের পরে লালবাজার। ফের পুলিশের লাঠির ঘায়ে রক্তাক্ত হল বামেদের অভিযান। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে আহত হলেন বাম নেতারা। তবে আড়াইখানা পুর-নিগম এবং শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের নির্বাচনের ৩৬ ঘণ্টা আগে কলকাতার রাজপথে জঙ্গি আন্দোলনের সুর চড়িয়ে কর্মী-সমর্থকদের বার্তা দিয়ে রাখলেন তাঁরা। বুঝিয়ে দিলেন, নির্বাচনের দিন ভোট লুঠ রুখতে সর্বাত্মক প্রতিরোধের চেষ্টায় নামুন কর্মীরা— এমনটাই চাইছে আলিমুদ্দিন।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৫ ০৪:০৩
পুলিশের লাঠির ঘায়ে জখম বাম কর্মী। বৃহস্পতিবার গণেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউয়ে। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

পুলিশের লাঠির ঘায়ে জখম বাম কর্মী। বৃহস্পতিবার গণেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউয়ে। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

নবান্নের পরে লালবাজার। ফের পুলিশের লাঠির ঘায়ে রক্তাক্ত হল বামেদের অভিযান। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে আহত হলেন বাম নেতারা। তবে আড়াইখানা পুর-নিগম এবং শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের নির্বাচনের ৩৬ ঘণ্টা আগে কলকাতার রাজপথে জঙ্গি আন্দোলনের সুর চড়িয়ে কর্মী-সমর্থকদের বার্তা দিয়ে রাখলেন তাঁরা। বুঝিয়ে দিলেন, নির্বাচনের দিন ভোট লুঠ রুখতে সর্বাত্মক প্রতিরোধের চেষ্টায় নামুন কর্মীরা— এমনটাই চাইছে আলিমুদ্দিন।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানার সাড়ে চার বছরে বামেদের ‘লালবাজার অভিযান’ আগেও হয়েছে। কিন্তু ২০১৬-র বিধানসভার লড়াইয়ের আগে সংগঠনের কলকব্জা চাঙ্গা করতে এ বারের পরিকল্পনা ছিল অন্য রকম। সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার থেকে বিমান বসু, ধর্মতলা থেকে সূর্যকান্ত মিশ্র এবং কলেজ স্কোয়ার থেকে মহম্মদ সেলিম— সিপিএমের তিন পলিটব্যুরো সদস্যের নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লালবাজারের দিকে এগোচ্ছিল তিনটি মিছিল। নবান্ন অভিযান এবং সাধারণ ধর্মঘটে আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখিয়ে ‘সাফল্যে’র পরে বাম-বাহিনীর মেজাজও ছিল চাঙ্গা। তিনটি মিছিলকেই প্রত্যাশিত ভাবে মাঝপথে আটকে দিয়েছিল পুলিশ। ব্যারিকেডের সামনে ধস্তাধস্তি, পুলিশের দিকে পচা ডিম ও টোম্যাটো ছোড়া এবং এ সবের জবাবে লাঠি হাতে মারমুখী পুলিশ— কিছু ক্ষণের মধ্যেই রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে গণেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউ ও ফিয়ার্স লেন। পুলিশের বেপরোয়া লাঠিতে আহত হন মহিলা-পুরুষ-বয়স্ক নির্বিশেষে বেশ কিছু বাম নেতা-কর্মী। সরকারের দাবি, পুলিশেরও ৬ জন আন্দোলনকারীদের ইটের ঘায়ে জখম হয়েছেন। একমাত্র বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে আটকে থাকা মিছিলটিকেই ডিসি সেন্ট্রাল বাস্তব বৈদ্যের দক্ষতায় লাঠি না-চালিয়েই সামাল দিতে পেরেছে পুলিশ।

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।

পুলিশের লাঠির ঘায়ে মাথায় গুরুতর চোট পেয়েছেন সিটুর রাজ্য সম্পাদক দীপক দাশগুপ্ত। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে গিয়ে মাথায় সেলাই দেওয়ার পরে রাতে তাঁকে হাওড়ার আন্দুল রোডের একটি বেসরকারি হাসাপাতালে আইসিইউ-এ স্থানান্তরিত করা হয়েছে। মাথা ফেটেছে আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুকুমার ঘোষের। ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রাক্তন কাউন্সিলর ঝুমা দাস পেটে, সিপিএমের অজয় সাহা মাথায় চোট পেয়েছেন। বামেদের দাবি, আহত অবস্থায় মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে ৩২ জনকে। বাকিদের প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমানবাবুর অভিযোগ, শুধু পচা ডিম আর স্লোগানের পরেই উত্তেজিত হয়ে ‘পুলিশ কোড’ না মেনে বেপরোয়া ভাবে লাঠি চালিয়েছে পুলিশ। সেলিমের অভিযোগ, বামেদের উপরে পুলিশ আক্রমণ করেছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই। আর সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যবাবুর মন্তব্য, ‘‘পুলিশ মানে পাবলিক সার্ভেন্ট। সার্ভেন্ট মানে কী, আপনারা জানেন। কিন্তু পুলিশ এখন তৃণমূলের সার্ভেন্ট হিসাবে কাজ করছে!’’ শাসক দলের লোকজন থানায় ঢুকে তাণ্ডব করলেও ফাইলের আড়ালে যারা লুকোয়, অপরাধীদের জামিনযোগ্য ধারা দেয়, তারাই কেন বিরোধীদের আন্দোলনের উপরে বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে— এ দিন পুলিশের সামনেই বারবার সেই প্রশ্ন তুলেছেন বাম নেতা-কর্মীরা। লাঠিচালনার প্রতিবাদে গণেশ অ্যাভিনিউ, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট এবং বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট ও চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে দীর্ঘক্ষণ অবরোধ চলে এ দিন। শাসক দলের সন্ত্রাস ও বামেদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে আক্রান্ত হওয়ার প্রতিবাদে আজ, শুক্রবার রাজ্য জুড়ে ‘ধিক্কার দিবসে’র ডাক দিয়েছেন বিমানবাবুরা। যে উপলক্ষকে কাজে লাগিয়ে ফের নির্বাচনের দিনের জন্য প্রতিরোধের বার্তাই দেওয়া হবে!

তবে বাম শিবিরের একাংশেই গুঞ্জন চলছে, যে ভাবে এ দিন সামান্য প্ররোচনাতেই পুলিশ লাঠি চালিয়েছে, প্রবীণ নেতা থেকে মহিলা কর্মী কেউ রেহাই পাননি— তার বিরুদ্ধে বিরোধী নেত্রী মমতা হলে রাতভর অবস্থান চালিয়ে যেতেন! কিন্তু বামেরা নির্দিষ্ট একটা সময়ের পরে রাস্তা খালি করে দিল! যদিও সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, ‘‘দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে সংগঠনের বড় অংশের মধ্যে জড়তা এসেছিল। সেটা কাটাতে সময় লাগে। নবান্ন অভিযান থেকে আবার সাহস ফিরছে। নেতারাও সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এটাই তফাত গড়ে দিচ্ছে।’’ শিলিগুড়ির পুরভোট থেকে এই ‘সাহস করে লড়াই’য়ের কথাই বারবার বলে আসছেন অশোক ভট্টাচার্য। সূর্যবাবুরা এখন যে দক্ষিণবঙ্গেও সেই ‘সাহস’ ছড়িয়ে দিতে চাইছেন, এ দিনের লালবাজার অভিযান থেকেই তার ইঙ্গিত স্পষ্ট বলে বাম সূত্রের ব্যাখ্যা।

শাসক দলের তরফে অবশ্য প্রত্যাশিত ভাবেই অভিযোগ করা হয়েছে, বামেরা শহরে অরাজকতা সৃষ্টি করতে চাইছে। রাজ্যের পুরমন্ত্রী ও তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিমের দাবি, ‘‘পুলিশকে আক্রমণ করা হয়েছে। আহত হয়ে চার পুলিশ এসএসকেএমে‌ ভর্তি। আত্মরক্ষার অধিকার সবার আছে!’’ তাঁর কটাক্ষ, ‘‘যাদের পায়ের তলায় মাটি নেই, তারাই এই অরাজকতা সৃষ্টি করে এবং আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে আমাদের রাজ্যের বদনাম করার চেষ্টা করছে!’’ পুরমন্ত্রীর দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, চার জন পুলিশ দেবল কুমার দাস, তারিণী কুমার রায়, রাজকৃষ্ণ শাহ ও গৌতম হালদার এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি। দুই মহিলা পুলিশ দোলা বিশ্বাস এবং নমিতা সরকারও আহত।

লাঠি চালানোর ঘটনার পরে বামফ্রন্টের তরফে চার জনের প্রতিনিধিদল সন্ধ্যায় লালবাজারের যুগ্ম নগরপাল (সদর) রাজীব মিশ্রের দেখা করে। বামেদের বক্তব্য, পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী পুলিশ কমিশনারের কাছে তাদের দাবিপত্র দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু লাঠিচালনার ঘটনার প্রতিবাদে তাঁরা যে আর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে চান না, সেই কথাই যুগ্ম নগরপালকে জানাতে গিয়েছিলেন তাঁরা। লালবাজার থেকে বেরিয়ে কলকাতা জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক নিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘দু’জায়গায় লাঠিচার্জ হয়েছে। পুলিশ বিনা প্ররোচনায় আমাদের উপরে লাঠি চালিয়েছে। এখানে আলোচনা করতে আসিনি। আলোচনার কোনও জায়গাই নেই!’’ যুগ্ম নগরপাল রাজীব পরে বলেন, ‘‘পুলিশকে লক্ষ্য করে বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ে ইট, ডিম ছোড়া হয়েছে। ফেস্টুনের লাঠি দিয়ে পুলিশকে আঘাত করা হয়েছে। বেশ কিছু পুলিশকর্মী আহত হয়েছেন। তাই পুলিশ পাল্টা ধাওয়া করেছে।’’ পুলিশ-কর্তা এমন দাবি করলেও গণেশ অ্যাভিনিউয়ে অবশ্য দেখা গিয়েছে, বন্ধ দোকানের সামনে ভাঙা টাইল্‌সের টুকরো তুলে নিতে উদ্যত কিছু বাম কর্মীকে হাত ধরে বাধা দিয়েছেন অন্য বাম কর্মীরাই।

শাসকের বিরুদ্ধে বামেরা পথে নেমে রুখে দাঁড়ানোর পরে বাকি বিরোধী শিবির থেকেও এখন সংহতির বার্তা আসছে। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য যেমন বলেছেন, ‘‘কোনও সভ্য সরকার এ ভাবে বিরোধী দলের মিছিলের উপরে হামলা চালাতে পারে, ভাবাই যায় না! এটা গণতন্ত্রের উপরে বর্বরোচিত আক্রমণ!’’

পুলিশের আচরণের নিন্দা করেছেন এসইউসি-র সৌমেন বসু (হাসপাতালে প্রতিনিধিও পাঠিয়েছেন), সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের পার্থ ঘোষ, পিডিএসের সমীর পূততুণ্ডও। রক্তপাতের দিনে এই বিরোধী সংহতির বার্তাকেই আরও প্রসারিত করে আসানসোলের বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় বলেছেন, ‘‘ভোটের দিন সন্ত্রাস হলে ঝান্ডার রং না দেখে সবাই মিলেই প্রতিরোধ করতে হবে।’’

abpnewsletters Left rally CPM Trinamool BJP
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy