ছোট্ট একটা জটলা। এক হাত থেকে অন্য হাতে ঘুরছে কল্কে, বোতল। গন্ধে মালুম পড়ে, জমিয়ে চলছে মাদক দ্রব্য সেবন। আর সেই আসরের বেশির ভাগ সদস্যই উঠতি যুবক বা কিশোর। — না দৃশ্যটা ‘উড়তা পঞ্জাবে’র নয়। বর্ধমানের কালনার। শহরের স্কুল-পড়ুয়াদের মধ্যে মাদক সেবনের এমন প্রবণতা চিন্তা বাড়িয়েছে শিক্ষক ও প্রশাসনের কর্তাদের।
সম্প্রতি কালনার বাসিন্দা দশম শ্রেণির এক ছাত্রের মৃত্যুর তদন্তে নেমে পড়ুয়াদের মধ্যে মাদকাসক্তির কথা জানতে পারেন পুলিশ আধিকারিকেরা। মাদক সেবনের প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় বিভিন্ন অসমাজিক কাজকর্ম, চুরি-ছিনতাইও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বলে মত বাসিন্দাদের।
শহর জুড়ে কী ভাবে চলছে মাদক দ্রব্যের এমন রমরমা?
দৃশ্য এক: শহরের স্টেশন চত্বর, পুরনো ও নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকা, দাঁতনকাঠিতলায় ছোট ছোট দোকানে পসরা সাজিয়ে বসেছেন কয়েক জন। আচমকা এক কিশোর এসে দোকানের সামনে দাঁড়াল। কিছু বলার আগেই হাতবদল হল একটা প্যাকেটের। একটু ঠাহর করলে বোঝা যায়, হাতবদল হল গাঁজার পুরিয়ার। কেউ বা আবার দোকানে এসে একশো টাকা ফেলছে। আর তারপরেই হাতে চলে আসছে হেরোইন!
দৃশ্য দুই: শহরেরই একটি ঠেক। সেখানে রীতিমতো আসর বসিয়েছে কয়েক জন স্কুল পড়ুয়া। মোবাইল বের করে কাকে যেন ফোন করল এক জন। খানিক বাদেই গাঁট্টাগোট্টা চেহারার এক জন মোটরবাইকে চড়ে হাজির। সঙ্গে থাকা থলি থেকে বের হল দু’টি বোতল। শুধু তাই নয়, মদের সঙ্গে ‘ডেলিভারি’ থাকছে হরেক কিসমের চাট, সোডার।
কালনায় কী ভাবে ঢুকছে গাঁজা, হেরোইন? সম্প্রতি যোগীপাড়া এলাকায় বাসিন্দাদের হাতে ধরা পড়ে পাঁচ হেরোইন বিক্রেতা। পুলিশ জানায়, তদন্তে জানা গিয়েছে, ভোরের আলো ফোটার আগেই কাটোয়া থেকে হেরোইন নিয়ে ঢুকে পড়ে কয়েক জন। তারপরে চাহিদা বুঝে তারা ছড়িয়ে পড়ে কালনার স্টেশন চত্বর, বৈদ্যপুর মোড়, দাঁতনকাঠিতলা-সহ বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে। মদের ‘ডেলিভারি’ দিতে গিয়ে আবার সামান্যতম লুকোছাপাও নেই। এক বিক্রেতা জানান, বোতল পিছু ২০ থেকে ৩০ টাকা করে লাভ হচ্ছে। চাট বা অন্য কিছুর দরকার হলে লাভ নাকি আরও বেশি। এক বিক্রেতা জানান, ফোনে মদের নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের নাম জানিয়ে দিলেই হল। যত রাতই হোক না কেন, ‘ডেলিভারি’ পৌঁছবেই। এ সব ছাড়াও রয়েছে আঠা পুড়িয়ে নেশা করার দৃশ্যও।
বাসিন্দাদের একাংশের বক্তব্য, মাদক দ্রব্য সেবনের প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপরাধও। ঊর্মিমালা সাহা নামে এক বধূর ক্ষোভ, ‘‘দিন কয়েক বাড়িতে তালা দিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার উপায় নেই। এসে হয়তো দেখব, বাড়ির দরজা-জানলার রড, সাইকেল, এমনকী ময়লা ফেলার বালতিও উধাও হয়ে গিয়েছে।’’ নেশায় মশগুল হয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে অনেক সময়েই দুর্ঘটনাও ঘটছে বলে প্রশাসনের কর্তাদের একাংশের ধারণা। বাসিন্দারা জানান, রাত ১০টা হলেই তেঁতুলতলা, শাহু সরকার মোড়-সহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় নেশাগ্রস্ত যুবকদের মোটরবাইক নিয়ে দাপাদাপি নজরে পড়ে। এর জেরে প্রায়শই ঘটছে দুর্ঘটনা।
স্কুল পড়ুয়াদের মধ্যে নেশার প্রভাব যে বেড়েছে, তা স্বীকার করছেন শিক্ষকেরাও। কালনা মহারাজা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্রীমন্ত ঘোষের যেমন বক্তব্য, ‘‘অন্তত ১০ জন মাদকাসক্ত পড়ুয়ার কথা জানি। অনেক সময়ে তারা স্কুলে আসার নাম করে ঠেকে যাচ্ছে। বিষয়টি অভিভাবকদেরও নজরে আনা হয়েছে। প্রশাসনেরও কড়া পদক্ষেপ করা দরকার।’’ কালনার পুরপ্রধান দেবপ্রসাদ বাগের দাবি, ‘‘একটি ওয়ার্ডেই মদ বিক্রির রমরমা রয়েছে। বিষয়টি পুলিশের নজরে আনা হয়েছে।’’ পুলিশের আশ্বাস, বেআইনি মদ বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে পুলিশের দাবি, শহরে হেরোইন বিক্রেতাদের সংখ্যা বর্তমানে অনেক কম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy