Advertisement
০৯ মে ২০২৪

পরিবর্তনের সেই ১৬ সৈনিক নেই লড়াইয়ে

ঘাড়ে এসে ‘থাবা’ই পড়ল! শুধু অনুপ ঘোষালেরই নয়। আরও ১৫ জনের। পাঁচ বছর আগে ‘পরিবর্তনের যুদ্ধে’ ওঁরা লড়াই করেছিলেন সামনে দাঁড়িয়ে। কেউ পুরোদস্তুর রাজনীতির লোক, কেউ গায়ক, কেউ প্রাক্তন পুলিশকর্তা।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৬ ০৩:৫০
Share: Save:

ঘাড়ে এসে ‘থাবা’ই পড়ল!

শুধু অনুপ ঘোষালেরই নয়। আরও ১৫ জনের।

পাঁচ বছর আগে ‘পরিবর্তনের যুদ্ধে’ ওঁরা লড়াই করেছিলেন সামনে দাঁড়িয়ে। কেউ পুরোদস্তুর রাজনীতির লোক, কেউ গায়ক, কেউ প্রাক্তন পুলিশকর্তা। ঘাসফুলের হাওয়ার তোড়ে জিতেও ছিলেন অনায়াসে। আর এ বার তাঁদের জায়গায় নতুন মুখ!

কলকাতা এবং রাজ্যের নানা প্রান্তে একটি-দু’টি করে আসনে এ বার তৃণমূল প্রার্থী বদল হলেও হাওড়া ও হুগলি— দুই জেলাতেই তিনটি করে আসনে প্রার্থী পাল্টে গিয়েছে। হুগলির উত্তরপাড়ায় অনুপ ঘোষালের জায়গায় এ বার তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন সাংবাদিক প্রবীর ঘোষাল। চন্দননগরের অশোক সাউয়ের জায়গায় আনা হয়েছে গায়ক ইন্দ্রনীল সেনকে। পুরশুড়ার পারভেজ রহমানের জায়গায় টিকিট পেয়েছেন গতবার দেগঙ্গা থেকে জেতা এম নুরুজ্জামান। হাওড়ার বালিতে সুলতান সিংহকে সরিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে বৈশালী ডালমিয়াকে। হাওড়া উত্তর কেন্দ্রে অশোক ঘোষের জায়গায় টিকিট পেয়েছেন লক্ষ্মীরতন শুক্ল। গ্রামীণ হাওড়ার জগৎবল্লভপুর কেন্দ্রে আবুল কাশেম মোল্লার জায়গায় এসেছেন আব্দুল গনি।

অথচ, প্রার্থী-তালিকা তৈরির সময়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব জানিয়েছিল, খুব ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি না হলে বর্তমান বিধায়কদের সব জায়গাতেই টিকিট দেওয়া হবে। শুক্রবার প্রার্থী-তালিকা প্রকাশের পরে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘‘নতুনদের সুযোগ করে দিতে কিছু সিদ্ধান্ত নিতেই হয়।’’

সাংবাদিকদের সামনে মমতা ওই কথা বললেও তাঁর দলেরই জেলা নেতারা কিন্তু অন্য কথা বলছেন। তাঁরা মনে করছেন, ওই সিদ্ধান্তের পিছনে ওই সব বিধায়কদের বিরুদ্ধে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে লাগাম টানতে না পারা-সহ নানা অভিযোগ জমা হচ্ছিলই। তাই কড়া সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলনেত্রী।

অনুপ ঘোষালের কথাই ধরা যাক। ‘হীরক রাজার দেশে’র গায়ক উত্তরপাড়ার বিধায়ক হওয়ার পরে দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। তাঁকে এলাকাতে প্রায় দেখাই যেত না। জনসংযোগ না থাকা এবং সভা-সমাবেশে তাঁকে না পাওয়া নিয়ে দলের অন্দরেই ক্ষোভ জমছিল। বিধায়ক হওয়ার সুবাদে উত্তরপাড়া বিধানসভা কেন্দ্রে বেশ কিছু স্কুলের পরিচালন সমিতিতে নানা পদে স্বজনপোষণের অভিযোগও ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। সে কারণে দলকে অস্বস্তিতেও পড়তে হয়। আর তাই এ বার তাঁর নাম দলনেত্রী বিবেচনার মধ্যেই আনেননি বলে মনে করছেন জেলা স্তরের অনেক নেতা।

যাঁরা টিকিট পেলেন না তাঁদের কাজকর্ম নিয়ে যেমন প্রশ্ন রয়েছে, তেমনই রয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামাল দিতে না পারার ‘অক্ষমতা’ও। সেই তালিকায় চলে আসছেন পুরশুড়ার পারভেজ রহমান, হাওড়া উত্তরে অশোক ঘোষ, বালির সুলতান সিংহ, ভাতারের বনমালি হাজরা, মেমারির আবু হাসেম মণ্ডলরা। যদিও প্রার্থী-তালিকায় স্থান না পাওয়ায় কারও মুখেই কোনও বিরূপ মন্তব্য শোনা যায়নি। পারভেজ যেমন বলেন, ‘‘দলের অনুগত সৈনিক হিসেবে দলনেত্রীর সিদ্ধান্তই মাথা পেতে নিলাম। এরপর দল যে দায়িত্ব দেবে, পালন করব। তবে, অপরাধটা জানলে নিজেকে শোধরাতে সুবিধা হতো।’’

অন্য দিকে, পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরার বিদায়ী তৃণমূল বিধায়ক রাধাকান্ত মাইতির বিরুদ্ধে অভিযোগ একটু অন্য রকম। দলেরই একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, রাধাকান্তবাবুর ছেলে অমিত মাইতির বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট চালানোর অভিযোগ আগেই শীর্ষ নেতৃত্বের কানে পৌঁছেছিল। তা ছাড়াও রাধাকান্তবাবুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে বাধা দেওয়ারও অভিযোগ ছিল। সেই কারণেই তাঁকে এ বার ভোটে প্রার্থী করা হল না।

তবে, উত্তরবঙ্গের দু’টি আসনে প্রার্থী বদলের কারণটা দুর্নীতি বলেই মনে করছেন অনেক তৃণমূল নেতা। বস্তুত, গত কয়েক বছর ধরে এসজেডিএ-র দুর্নীতি তৃণমূলকে অনেকটাই অস্বস্তিতে ফেলেছে। শিলিগুড়ির বিধায়ক রুদ্রনাথ ভট্টাচার্যই ছিলেন ওই সংস্থার চেয়ারম্যান। তাঁর নাম নিয়ে বিরোধীরা প্রচার করতে থাকে। পুরসভা, পঞ্চায়েত ভোটে এর ফল পায় বামফ্রন্ট। প্রায় ৮০ কোটি টাকার দুর্নীতিতে এসজেডিএ-র সিইও গোদালা কিরণ কুমার থেকে বাস্তুকার মৃগাঙ্কমৌলি সরকারের মতো একাধিক সরকারি অফিসার, ঠিকাদার গ্রেফতার হন। রুদ্রনাথবাবুকে চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে সেই জায়গায় আনা হয় উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবকে। তাই বর্তমান বিধায়ককে আবার টিকিট দিলে প্রচার কোন দিকে যাবে, তা তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব হয়তো আঁচ করেছিলেন। দিনের শেষে টিকিট না পেলেও বিদায়ী বিধায়ক রুদ্রবাবু বলেন, ‘‘আমি তৃণমূল কর্মী। দলনেত্রীর নির্দেশে কাজ করব। ভাইচুং জনপ্রিয় প্রার্থী। এ বারও আমরা শিলিগুড়িতে জিতব।’’ দক্ষিণ দিনাজপুরে কুমারগঞ্জে বিধায়ক মাহমুদা বেগম বাদ পড়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠেছিল। ছিল দুর্নীতির নালিশও।

১৬ জন তো বাদ গেলেন। কিন্তু এমন অনেক কেন্দ্র রয়েছে, যেখানে যাঁদের প্রার্থী করা হয়েছে, স্থানীয় নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশ তাঁদের চাননি। তাঁদের প্রার্থী হওয়া ঠেকাতে তাঁরা দলের শীর্ষ নেতৃত্ব পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন। রাস্তায় নেমে বিক্ষোভও করেছিলেন। যেমন, রায়দিঘির দেবশ্রী রায়, পাঁচলার গুলশন মল্লিক, সাতগাছিয়ার সোনালি গুহ, উলুবেড়িয়া উত্তরের নির্মল মাজি বা সিঙ্গুরের রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। কিন্তু তাঁরা টিকিট পেয়েছেন। তা নিয়ে যে দলে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকবে এটাও সম্ভবত মেনে নিয়েছেন দলীয় নেতৃত্ব। এ দিনই যেমন দেগঙ্গায় তৃণমূল নেতা মিন্টু সাহাকে প্রার্থী করা হয়নি বলে বিক্ষোভ দেখান তাঁর অনুগামীরা।

এ সব আঁচ করেই বোধ হয় দলনেত্রী মমতা এ দিন বলেন, ‘‘এমন অনেককে টিকিট দিতে হল, না দিলে হয়তো ভাল হতো।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

tmc candidate drop
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE