মঙ্গলবার কলকাতায় সাংবাদিক বৈঠকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ছবি: পিটিআই।
বিধানসভা নির্বাচনের আগে দলীয় সংগঠনের হাল-হকিকত বুঝে নিতে কলকাতায় এসেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। মঙ্গলবার তাঁর সফরের দ্বিতীয় দিন। এ বারের সফরে কোনও প্রকাশ্য জনসভা নেই। ফলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির দলীয় কর্মী-সমর্থকদের বার্তা দিতে সাংবাদিক বৈঠককেই বেছে নিলেন তিনি। রাজ্যের সাধারণ জনতার মন ছুঁয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করলেন তিনি।
মঙ্গলবার দুপুরে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ধরে সাংবাদিক বৈঠক করলেন তিনি। এক পাশে বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য, অন্য পাশে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে বসেন তিনি। সাংবাদিক বৈঠকে ছিলেন দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার এবং শান্তনু ঠাকুরও।
সাংবাদিক বৈঠকের প্রথম ২৭ মিনিট ছিল দলীয় কর্মী-সমর্থক এবং রাজ্যবাসীর উদ্দেশে শাহের বার্তা। তার পরে শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। শেষ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পরে আসন ছেড়ে উঠতে উঠতে সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে শাহ বুঝিয়ে দেন, সাংবাদিক বৈঠক ওই মুহূর্তেই শেষ হচ্ছে। উঠতে উঠতেই তিনি বলেন, “প্রশ্ন সাজানো হচ্ছে।” এই বলে সাংবাদিক বৈঠক শেষ করেন তিনি।
তবে মঙ্গলবার কলকাতায় শাহের সাংবাদিক বৈঠকের একটি বড় অংশ জুড়ে থাকল রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ। এ ছাড়া দুর্নীতি, অপশাসন এবং সন্ত্রাসের অভিযোগেও বিঁধলেন তৃণমূল সরকারকে। প্রশ্ন তুললেন রাজ্যের নারী নিরাপত্তা নিয়েও। একই সঙ্গে মতুয়াদের উদ্দেশেও অভয়বার্তা দিয়ে রাখেন শাহ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “মতুয়াদের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। যে শরণার্থীরা পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, তাঁরা ভারতের নাগরিক। এটা বিজেপির প্রতিশ্রুতি। তাঁদের কেউ ক্ষতি করতে পারবেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পারবেন না।”
রাজ্য সরকারের কাছে জমি চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ শাহের। তিনি বলেন, “সাতটা চিঠি মমতাজিকে লিখেছি। গত ছয় বছরে স্বরাষ্ট্রসচিব তিন বার পশ্চিমবঙ্গে এসে বৈঠক করেছেন। তার পরেও তৃণমূলের সরকার কেন জমি দিচ্ছে না?”
শাহ বলেন, “ভারত সরকার পুরো দেশে পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ করছে। সব জায়গায় পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ হচ্ছে, শুধু পশ্চিমবঙ্গে কেন আটকাচ্ছে? তামিলনাড়ু, তেলঙ্গানায় কেন সমস্যা হচ্ছে না? অখিলেশ যাদব মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কেন উত্তরপ্রদেশেও সমস্যা হয়নি?”
মতুয়াদের উদ্দেশে শাহ বলেন, “মতুয়াদের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। যে শরণার্থীরা পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, তাঁরা ভারতের নাগরিক। এটা বিজেপির প্রতিশ্রুতি। তাঁদের কেউ ক্ষতি করতে পারবেন না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও পারবেন না।” সাংবাদিক বৈঠকে শাহের সঙ্গে উপস্থিত রয়েছেন ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়ির অন্যতম মুখ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরও।
একদিকে শুভেন্দু, একদিকে শমীককে নিয়ে বসে রাজ্যবাসীর উদ্দেশে শাহ বলেন, “আপনারা দীর্ঘ দিন কংগ্রেসকে সময় দিয়েছেন, ৩৪ বছর বামেদের দিয়েছেন, ১৫ বছর মমতাজিকে দিলেন। আমার বিনীত অনুরোধ, এ বার মোদীজির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার বানান, পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিন।”
রাজ্যে বড় শিল্পের অভাব নিয়েও পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে নিশানা করেন শাহ। তিনি বলেন, “কামানোর অধিকার এখানে একমাত্র ভাইপোর। আর কারও অধিকার নেই। শিল্পক্ষেত্রে বাংলা পুরোপুরি ধ্বংস। তা আপনার আমলে হয়েছে। বামেরা অর্ধেক শেষ করে গিয়েছিল। আপনি পুরোটা শেষ করে দিয়েছেন।”
রাজ্যে মুখ্যসচিব বা পুলিশের ডিজি নিয়োগের নিয়ম না মানার অভিযোগ তুললেন শাহ। তাঁর দাবি, ভারত সরকারের কর্মিবর্গ প্রশিক্ষণ দফতরের বিধি বিকৃত করা হচ্ছে এ রাজ্যে।
কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গে কেন কার্যকর হচ্ছে না, তা নিয়েও উষ্মাপ্রকাশ করেন শাহ। তাঁর দাবি, “ভোটব্যাঙ্ক হারানোর ভয় পান মমতা।” সেই কারণেই কেন্দ্রের প্রকল্প রাজ্যে কার্যকর করতে দেওয়া হয় না বলে দাবি শাহের। উল্লেখ করেন পিএম কিসান এবং আয়ুষ্মান ভারতের মতো প্রকল্পগুলির কথাও। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “মোদীজিকে ভয় পান, তাঁর জনপ্রিয়তাকে ভয় পান, তাই আয়ুষ্মান ভারত কার্যকর হতে দিচ্ছেন না।”
রাজ্য সরকার তোষণের রাজনীতি করছে বলেও অভিযোগ তোলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ অভিযোগ আগেও বার বার তুলেছে বিজেপি। মঙ্গলবার শাহ বলেন, “এখন মলম লাগানোর চেষ্টা হচ্ছে দেখছি। কোনও মলম আর কাজ করবে না।”
নারী নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন শাহ। রাজ্য সরকারকে বিঁধে তিনি বলেন, “সন্ধ্যা ৭টার পরে মহিলাদের ঘর থেকে না বেরোনোর পরামর্শ দিচ্ছেন! কোন জমানায় রয়েছি আমরা? মোগল যুগে নাকি?” নারী নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের সময়ে আরজি কর হাসপাতাল, সন্দেশখালি এবং দুর্গাপুরের প্রসঙ্গও টানেন শাহ।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ বলেন, “বাংলার সীমান্ত দিয়ে যে অনুপ্রবেশ হচ্ছে, তা শুধু বাংলার বিষয় নয়। পুরো দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশ্ন। এমন মজবুত সরকার এখানে আনুন, যারা এখানে অনুপ্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে।”
শাহ আরও বলেন, “নরেন্দ্র মোদী তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তার পরে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, দিল্লি এবং বিহারে আমরা জিতেছি। ২০২৪ সালে ওড়িশা এবং অনিধ্রে বিজেপি ও এনডিএর সরকার হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ এ বার দুই তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা নিয়ে আমাদের সরকার হবে। মমতাজি, এই সাংবাদিক বৈঠক থেকে আপনাকে জিজ্ঞাসা করছি, কোন সরকার আছে, যারা বর্ডারে বেড়া দেয়ার জন্য জমি দেয় না? আপনি জবাব না দিতে পারলে আমি দিচ্ছি। শুধু আপনার সরকারই এ রকম করে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জবাব দিতে পারবেন, অসম, ত্রিপুরায় অনুপ্রবেশ কী ভাবে বন্ধ হয়েছে? আপনার প্রশ্রয়েই এখানে অনুপ্রবেশ হচ্ছে এবং তাঁদের আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।”
রাজ্যে বিজেপির অতীত নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে শাহ বলেন, “এ বার যে বাংলায় বিজেপির সরকার হবে, তা মজবুত ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে বলছি। ২০১৪ সালে ১৭ শতাংশ ভোট। ২০১৬ সালে ১০ শতাংশ ভোট। ২০১৯ সাল ৪১ শতাংশ ভোট, ১৮ আসন। ২০২১ সালে ৩৮ শতাংশ ভোট, ৭৭ আসন। ২০২৪ সালের ভোটে ৩৯ শতাংশ ভোট এবং ১২টি আসন। ২০২৬ সালে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়ব।”
রাজ্য সরকারকে নিশানা করে শাহ বলেন, “উন্নয়ন চলে গিয়েছে সিন্ডিকেটের কবলে। বিজেপি সরকার গঠন করার পরে বঙ্গ গৌরব, বঙ্গ সংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ঘটাব। স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমবাবু, গুরুদেব এবং শ্যামাপ্রসাদের স্বপ্নের বাংলা বানাব।”
শাহ বলেন, “এপ্রিলে নির্বাচন হবে। ভয়, দুর্নীতি, কুশাসনে বাংলার মানুষ চিন্তিত, উদ্বিগ্ন এবং ভীত। এমন মজবুত রাষ্ট্রীয় গ্রিড বানাব যে বাংলায় অনুপ্রবেশ সমাপ্ত হয়ে যাবে। মানুষ কেন, পাখিও ঢুকতে পারবে না।”
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, “এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে দুর্নীতির কারণে গোটা বাংলার বিকাশ একপ্রকার থমকে গিয়েছে।দুর্নীতিতে গোটা বাংলার জনতা ত্রস্ত। রোজভ্যালি চিটফান্ড, ক্যাশ ফর কোয়ারি, এসএসসি, পুরনিয়োগ, গরুপাচার, রেশন, ১০০ দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার দুর্নীতি— এত দুর্নীতি রয়েছে পুরো তালিকা বলতে গেলে আমার পুরো সাংবাদিক বৈঠকই তাতে কেটে যাবে।”
রাজ্যে দুর্নীতির অভিযোগ প্রসঙ্গে মমতাকে বিঁধে শাহ বলেন, “আপনার মন্ত্রীর ঠিকানা থেকে ২৭ কোটি টাকা পাওয়া যায়। যা গুনতে গুনতে নোট গোনার মেশিনও গরম হয়ে যায়। বাংলার মতো গরিব রাজ্য থেকে ২৭ কোটি, ২০ কোটি, ১৫ কোটি করে টাকা পাওয়া যাচ্ছে। আপনার কোনও দায় নেই? পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, অনুব্রত মণ্ডল, জীবনকৃষ্ণ সাহা, মানিক ভট্টাচার্য, চন্দ্রনাথ সিংহ, পরেশ পাল, কুন্তল ঘোষেরা জেলে যান। ফিরহাদ হাকিম, শোভন চট্টোপাধ্যায়দের অভিযুক্ত বলা হয়। কুণাল ঘোষ তিন বছর জেল কাটিয়ে আসেন। আর আপনি বলছেন দুর্নীতি হচ্ছে না! আপনি চোখ বন্ধ করে আছেন। কিন্তু বাংলার জনতা চোখ বন্ধ করে বসে নেই।”
শাহ বলেন, “আজকের দিনে ১৯৪৩ সালে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু পোর্ট ব্লেয়ারে প্রথম বার স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। এটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ দিন।”
দুপুর ১২টা নাগাদ শুরু হল অমিত শাহের সাংবাদিক বৈঠক। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন শমীক ভট্টাচার্য, শুভেন্দু অধিকারী এবং সুকান্ত মজুমদার। রয়েছেন শান্তনু ঠাকুরও।
মঙ্গলবার দুপুর ১২টা নাগাদ শুরু হবে শাহের সাংবাদিক বৈঠক। রাজ্য বিজেপির একটি সূত্রের দাবি, ওই সাংবাদিক বৈঠকে ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর নিয়ে কেন্দ্র তথা বিজেপির অবস্থান আরও এক বার স্পষ্ট করতে পারেন তিনি। এসআইআর প্রক্রিয়ায় একাধিক অনিয়ম এবং সাধারণ মানুষকে হেনস্থার অভিযোগ তুলে নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি দেশের শাসকদল বিজেপির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে বিরোধী দলগুলি। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনেও এই বিষয়টি বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এই আবহে কেন্দ্র বিরোধীদের অভিযোগ নস্যাৎ করতে শাহ কোনও বার্তা দেবেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
মঙ্গলবারও জোড়া বৈঠক রয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। মঙ্গলবার বিধাননগরে দুপুর ২টো নাগাদ একটি বৈঠক করার কথা রয়েছে তাঁর। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলতে পারে সেটি। এর পরে তিনি যাবেন আরএসএস-এর দফতর কেশব ভবনে। বিকেল সাড়ে ৪টে থেকে সেখানে সঙ্ঘের নেতৃত্বের সঙ্গে সমন্বয় সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। এই দুই বৈঠকের আগে দুপুরে একটি সাংবাদিক বৈঠকেও বসার কথা রয়েছে শাহের।
সোমবার রাতে রাজ্য বিজেপির নেতাদের সঙ্গে একটি সাংগঠনিক বৈঠক সারেন শাহ। রাজ্য বিজেপির প্রথম সারির নেতারা ছাড়াও ওই বৈঠকে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারাও। প্রায় ঘণ্টাখানেক রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলে। সেই বৈঠকে কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, তা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও বিজেপি নেতাই মুখ খোলেননি। তবে বিজেপি সূত্রে খবর, এই বৈঠকে মূলত জনসংযোগের বিষয় আলোচনা হয়েছে। জনসংযোগের ক্ষেত্রে রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্ব কী কী পরিকল্পনা করেছেন, সেই সব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে— সেই সব সম্পর্কে জানতে চান শাহ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সেই হিসাবই তুলে ধরেন তুলে ধরেন রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy