Advertisement
E-Paper

অমিতের রোড শো ঘিরে দফায় দফায় সংঘর্ষ-আগুন-ভাঙচুর, ভাঙল বিদ্যাসাগরের মূর্তি

রাতেই বিদ্যাসাগর কলেজে পৌঁছন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন তিনি। কথা বলেন আহত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেও।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে উত্তেজনা। নিজস্ব চিত্র।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে উত্তেজনা। নিজস্ব চিত্র।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৯ ২২:০৬
Share
Save

শান্তিতে শেষ হল না অমিত শাহের রোড শো। শুরু হওয়ার আগে থেকেই টানাপড়েন চলছিল পুলিশ-বিজেপিতে। অমিত শাহ কলেজ স্ট্রিটে পৌঁছতেই দফায় দফায় সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল বিজেপি এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদের মধ্যে। ইট-বোতল-জুতো ছোড়াছুড়ি, বাইকে আগুন, বিদ্যাসাগর কলেজে ভাঙচুরের পাশাপাশি পুলিশের লাঠিচার্জ— বাকি থাকল না কিছুই। ঘটনা ঘিরে শুরু হয়েছে তুমুল চাপানউতোর। বিজেপি সভাপতি এবং তৃণমূল চেয়ারপার্সন তীব্র আক্রমণ করেছেন পরস্পরকে।

রাস্তা ৫ কিলোমিটারের সামান্য বেশি। সেইটুকু পথ পেরতে সময় লাগল পাক্কা আড়াই ঘণ্টা। অমিত শাহর রোড শো ঘিরে সমাগমটা ঠিক কী চেহারা নিয়েছিল মঙ্গলবার, তার খানিকটা আভাস সম্ভবত এই তথ্য থেকেই মেলে। কিন্তু বিজেপি সভাপতি রোড শো শুরু করার আগে থেকেই যে ভাবে ফুলের পাপড়িতে গেরুয়া গালিচা তৈরি হয়ে গেল রাস্তা জুড়ে, যে ভাবে যাত্রাপথের দু’ধার থেকে পুষ্পবৃষ্টি হল, শ’য়ে শ’য়ে ঢাক-ঢোল, ব্যান্ড পার্টি, লোকনৃত্য, আতসবাজি, কনফেটি, গেরুয়া বেলুন, আতসবাজিতে যে ভাবে রামধনু রং নিয়ে নিল শাহী রোড শো, তা না দেখলে বোঝা শক্ত যে, আবহটা কী ভাবে উৎসবের চেহারা নিয়েছিল।

কিন্তু শেষটা মোটেই সুখকর হল না। রোড শো বদলে গেল রাজনৈতিক সংঘর্ষে। বিজেপির সঙ্গে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের তুমুল সংঘর্ষে রক্তাক্ত হল বিধান সরণি। বিবেকানন্দের জন্মভিটেতে না ঢুকেই ঘটনাস্থল ছাড়তে হল অমিত শাহকে।

আরও পড়ুন: অমিতের রোড শোয়ে দফায় দফায় বিজেপি-টিএমসিপি সংঘর্ষ, তীব্র উত্তেজনা বিধান সরণিতে

বিজেপি-টিএমসিপির সংঘর্ষে বিদ্যাসাগর কলেজে ভাঙচুরের ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অমিত শাহকে ধিক্কার জানিয়েছেন তিনি। বিজেপি সভাপতিও তীব্র আক্রমণ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বাংলায় সন্ত্রাসের রাজত্ব চলছে বলে অভিযোগ করে শেষ দফার ভোটগ্রহণে তৃণমূলকে ‘যোগ্য জবাব’ দেওয়ার ডাক দিয়েছেন তিনি। বিজেপির বিরুদ্ধে অবিলম্বে লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়ার জন্য পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। অন্য দিকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে রাতেই দিল্লিতে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের দফতরে যায় বিজেপি। অবিলম্বে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমস্ত প্রচারে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে, নির্বাচন কমিশনের কাছে এই আবেদন জানিয়েছে তারা। হিংসা ছড়ানোর অভিযোগেই এই দাবি তোলা হয়েছে বলে সাংবাদিক সম্মেলন করে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং বিজেপি নেত্রী নির্মলা সীতারামন।

বাইরে থেকে লোক এনে বিজেপি কলকাতায় রোড শো করছে বলে সন্ধ্যা নাগাদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছিলেন, লোক না থাকলে রোড শো করার দরকার কী? এমন প্রশ্নও তুলেছিলেন তিনি কটাক্ষের সুরে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মন্তব্যের অনেক আগে থেকেই বিজেপি সভাপতির রোড শোয়ের বিরোধিতার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। ধর্মতলা থেকে শাহ যখন শুরু করেছেন যাত্রা, তখনই কলেজ স্ট্রিটে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে কালো পতাকা হাতে নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কিছু কর্মী-সমর্থক। দেওয়া হচ্ছিল, ‘অমিত শাহ গো ব্যাক’ স্লোগান। ‘গণতন্ত্রের হত্যাকারী’ লেখা পোস্টার নিয়ে অবস্থান করছিলেন তাঁরা। ঘটনাস্থলে হাজির হয়েছিলেন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের সমর্থকেরাও। উত্তেজনা সামাল দিতে যুযুধান দুই পক্ষের মাঝে মোতায়েন করা হয়েছিল বিশাল পুলিশবাহিনী।

অমিত শাহ কলেজ স্ট্রিটের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পৌঁছতেই চরমে ওঠে উত্তেজনা। অমিত শাহ যাতে কালো পতাকা দেখতে না পান, সেই জন্য বড় ব্যানার দিয়ে রাস্তার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকটি ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করেন বিজেপি কর্মী সমর্থকেরা। অন্য দিকে পুলিশ চেষ্টা করলেও সরানো যায়নি ছাত্রছাত্রীদের। এর পর মিছিলের দিক থেকে জুতো, জলের বোতল ছোঁড়া হয় ছাত্রছাত্রীদের দিকে। ইটবৃষ্টির মধ্যে ব্যারিকেড ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢুকতে চেষ্টা করেন বিজেপি কর্মী সমর্থকেরা। কম্যান্ডোরা ঘিরে ধরেন অমিত শাহকে।

ফেস্টুন, ব্যানার দিয়ে টিএমসিপি-র বিক্ষোভ আড়াল করার চেষ্টা বিজেপি কর্মীদের। নিজস্ব চিত্র।

এ যাত্রায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া গেলেও পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায় বিধান সরণিতে বিদ্যাসাগর কলেজের সামনে বিজেপির মিছিল পৌঁছতেই। টিএমসিপি এবং বিজেপি কর্মী সমর্থকদের সংঘর্ষ ঘিরে রীতিমতো অগ্নিগর্ভ হয় পরিস্থিতি। ইট-বোতল-জুতো বৃষ্টি, বাইকে আগুন — বাকি থাকে না কিছুই। পুলিশের অনুপস্থিতিতে চরমে ওঠে উত্তেজনা। বিজেপির অভিযোগ, বিদ্যাসাগর কলেজের ভিতর থেকে মিছিলের দিকে ইট ছোড়া হয়। মাথা ফেটে যায় এক বিজেপি কর্মীর। তখনই মিছিলে আসা বিজেপি কর্মীরা কলেজে হামলা চালান। বিদ্যাসাগর কলেজে ভেঙে দেওয়া হয় বিদ্যাসাগরের মূর্তিও। ভেঙে দেওয়া হয় কলেজের গেট, আসবাব। তৃণমূলের দাবি, কলেজ থেকে শুধুমাত্র মোদীবিরোধী পোস্টার দেখানো হয়েছিল, কোনও ইট ছোড়া হয়নি, পোস্টার দেখেই ইট-রড নিয়ে বিজেপি হামলা চালায়। পুলিশের অনুপস্থিতির জেরে দীর্ঘ ক্ষণ চলতে থাকে সংঘর্ষ। অশান্তির আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর কলেজের সামনে কেন পুলিশ ছিল না, কেন পুলিশ পৌঁছতে অনেক দেরি করল, সে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন শিবির থেকে।

অমিত শাহ কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বামী বিবেকানন্দের বাড়িতে পৌঁছতে পারেননি। সেখানে পৌঁছনোর আগের মোড়টাতেই ব্যারিকেড করে রেখেছিল পুলিশ। সেখান থেকেই অমিত শাহের গাড়ি ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। এই প্রসঙ্গে অমিত শাহ বলেন, ‘‘আচমকা তৃণমূলের কিছু গুন্ডা আমাদের রোড শোয়ে হামলা চালায়। বিবেকানন্দের বাড়িতে পৌঁছতে পারিনি। বিবেকানন্দের মূর্তিতে মালা দিতে পারিনি। পুলিশ তার আগেই আমার গাড়ি ঘুরিয়ে দেয়।’’

অন্য দিকে বিদ্যাসাগর কলেজে ভাঙচুরের ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অভিযোগ, বাইরে থেকে গুন্ডা নিয়ে এসে এই হামলা চালিয়েছে বিজেপি। বিজেপির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করার পাশাপাশি বিদ্যাসাগর কলেজে গিয়ে ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নির্দেশ দেন তিনি। পরে নিজেও ঘটনাস্থলে গিয়ে সরেজমিনে দেখে আসেন পরিস্থিতি। এই ঘটনার কড়া নিন্দা করেছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। তিনি বলেছেন, ‘‘বিদ্যাসাগরের এই অপমানের জবাব দেবেন বাংলার মানুষ। বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করতে চাইছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক এবং ছাত্রসমাজ এই গুন্ডামির জবাব দেবেন।’’

নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানানো হবে বলে জানিয়েছেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ-ও। তাঁর অভিযোগ, ‘‘যে সব গুন্ডা এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা আছে, তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে ভারতের সমস্ত রাজ্যেই। একমাত্র ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গে। এখানে গুন্ডা-অপরাধীদের গ্রেফতার করা হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন চোখ বন্ধ করে বসে রয়েছে।’’

রাতে বিদ্যাসাগর কলেজে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথা বলেন আহত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে। সেখানে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘ মণীষীদের গায়ে হাত দিলে ছাড়ব না। বিজেপির কাজে লজ্জিত বোধ করছি।’’

অন্য দিকে, নির্বাচনী প্রচার থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলার পাশাপাশি নির্মলা সীতারামন বলেন, ‘‘সাংবিধানিক পদে থেকেও নির্বাচনী প্রচারের মঞ্চ থেকে লাগাতার অসাংবিধানিক কথা বলে চলেছেন মমতা। উনি বলছেন, ‘ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বদলা নেব’। এই ভাবে তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের হিংসায় প্ররোচিত করছেন উনি। তার জেরেই আজ আমাদের দলীয় সভাপতির রোড শোয়ে হামলা হয়েছে। ইট-পাথর ছুড়ে আমাদের সভাপতিকে আক্রমণ করা হয়েছে।’’

তিনি আরও বলেন, ‘‘কলকাতায় সাংঘাতিক হিংসা, সংঘর্ষ, আগ্নিসংযোগ হয়েছে। এই পরিস্থিতি চলতে পারে না। সারা দেশে শান্তিতে নির্বাচন হবে, পশ্চিমবঙ্গে হবে না, এটা হতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে শান্তিতে নির্বাচন করাতে না পারলে, এ বার নির্বাচন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান প্রশ্নের মুখে পড়বে।’’ নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, ‘‘যা করতে হয় করুন, বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয় নিন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করুন।’’

Lok Sabha Election 2019 Amit Shah লোকসভা ভোট ২০১৯ Kolkata Rally Vidyasagar College Vandalization অমিত শাহ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লোকসভা নির্বাচন ২০১৯ Mamata Banerjee BJP TMC
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy