Advertisement
১১ মে ২০২৪

এমন অঙ্ক আগে কষেনি রায়গঞ্জ

ইসলামপুরের দাড়িভিট স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত অশান্তিতেই দুই যুবকের মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল গোটা রাজ্য।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

রবিশঙ্কর দত্ত
রায়গঞ্জ শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:০৩
Share: Save:

ভাল করে ঘুম ভাঙেনি বাকি পাড়ার। তখনই স্নান সেরে পাজামা-পাঞ্জাবির উপরে সাদা খাদা ঝুলিয়ে নিয়েছেন কাঁধে। পার্টি অফিসের দোতলা থেকে তরতর করে নেমে যে ক্লিপ-বোর্ডটা হাতে নিলেন তাতে রাত বারোটা পর্যন্ত গোটা দিনের কর্মসূচি। চোখমুখ ঝলসে গিয়েছে রোদে। গলাও ভেঙেছে। মধ্যরাত পর্যন্ত নিয়ম করে এ ভাবেই ছুটছেন মহম্মদ সেলিম।

মোহনবাটি বাজারে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে তা শুনে পঞ্চাশ পেরনো ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘‘ছুটছেন ঠিকই কিন্তু সিপিএম আর সেই সিপিএম নেই।’’ ২০১৪ সালে তো সিপিএমের প্রার্থী হিসাবে জয় পেয়েছিলেন সেলিম। সেই ভোট কী ভাবে রক্ষা করা যায় গত একমাসের প্রচারে সেই চেষ্টাই করছেন বিদায়ী সাংসদ। কিন্তু পারবেন কি? পারলে কতটা? কারণ চেনা ভোট মেশিনারি দূরে থাক, বহু জায়গায় সিপিএমের সক্রিয়তাই নজরে পড়ছে না। বরং বাসি ধুলোয় ঢাকা স্করপিওতে দিন শুরুর মুখে তিনি এমন ফোন পাচ্ছেন, যাতে শুনছেন, এলাকায় ফ্লেক্স, ব্যানার, পোস্টার, দেওয়াল-লেখা না হওয়ার কথাও। এখন তা নিয়ে হিসাব চলছে সিপিএম তথা বামেদের অন্দরেও।

ইসলামপুরের দাড়িভিট স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত অশান্তিতেই দুই যুবকের মৃত্যু নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল গোটা রাজ্য। সিবিআই তদন্তের দাবিতে এখনও মৃতদের সৎকার হয়নি। দোলঞ্চা নদীর পাড়ে মাটি চাপা সেই দেহজোড়া অবশ্য তখন থেকেই এ জেলার রাজনীতির কেন্দ্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। আর গত একবছরে মূলত তার উপরে ভরসা করেই মাথা তুলেছে বিজেপি। তা অস্বীকার করছেন না সেলিম। তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি কর্ণাটকের হুবলিতে যা করেছে, দাড়িভিটেও সেই চেষ্টা করেছে। ওরা সিবিআই করেনি। তৃণমূলও তদন্ত করেনি। এই পরিস্থিতির সুযোগে যাতে ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে ভোট না হয়, সেই চেষ্টা করতে হচ্ছে।’’ তবে সেলিম আশাবাদী। তাঁর বিশ্বাস, রায়গঞ্জে সাংসদ তহবিলের সব টাকা খরচ এবং সংসদে রায়গঞ্জের কথা বলার জন্য তিনি সমর্থন পাবেন।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

গত লোকসভা ভোটেও রায়গঞ্জের হেমতাবাদ, চাকুলিয়া, করণদিঘিতে সিপিএমের ভোট ছিল ৫০ শতাংশের বেশি। শেষ পঞ্চায়েত ভোটে এখানে জেলা পরিষদের একটি আসনও পেয়েছিল বামেরা। তবু সিপিএম বা বামেদের নিয়ে সংশয়। কারণ উত্তর দিনাজপুরে দলের সংগঠন অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। রাজ্যের শাসক-বিরোধী হাওয়াও ধরতে পারেননি তারা। সেই সূত্রে এবার রায়গঞ্জের উচ্চগ্রামের লড়াইয়ে বেশ খানিকটা স্তিমিতই দেখাচ্ছে সিপিএম তথা বামেদের গতি। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে সামনের দিকে থাকলেও পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকে সেভাবে লড়াই দিতে পারেননি সিপিএম।

ওই ভোটে সিপিএমের কাছে সামান্য ভোটে হেরে যাওয়া কংগ্রেসও এবার বুক বাজিয়ে বাজিমারার দাবি করতে পারছে না। এই আসনে দলের প্রার্থী দিতে জেদ ধরেছিলেন জেলা কংগ্রেস সভাপতি মোহিত সেনগুপ্ত। কার্যত সেই জেদ রাখতেই সিপিএম তথা বামেদের সঙ্গে জোটের কথা ভেস্তে যায় কংগ্রেসের। কিন্তু গত নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে থাকা কংগ্রেস কি এবার লড়াইয়ে থাকতে পারবে? মোহিতবাবু বলছেন, ‘‘রায়গঞ্জে বিজেপি মাথা তুলেছে ঠিকই তবে তাদের সঙ্গে লড়াই হবে কংগ্রেসের। যে প্রেক্ষাপটে বিজেপির সঙ্গে এই লড়াই, তাতে মানুষ আমাদের উপরেই আস্থা রাখবেন।’’ কংগ্রেস প্রার্থী তথা প্রাক্তন সাংসদ দীপা দাসমুন্সি বলছেন, ‘‘এবারের ভোট হচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর জায়গায় রাহুল গাঁধীকে প্রধানমন্ত্রী করার ভোট। বিজেপির বদলে কংগ্রেসের সরকার গড়ার ভোট। মানুষ নিশ্চই তা বিবেচনা করছেন।’’

কিন্তু মোদী-বিরোধিতার একচ্ছত্র দাবি নিয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটারের রায়গঞ্জে ঝাঁপিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সংখ্যালঘু ভোটের নির্ণায়ক অংশ ঝুলিতে পেতে ছুটছেন তৃণমূল প্রার্থী কানাইয়ালাল অগ্রবালও। তাঁর কথায়, ‘‘সারা দেশে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এটা প্রমাণিত। বিজেপি বিরোধী এই ভোট ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’’ তবে রোদে ‘ফর্সা কৃষ্ণ কালো হয়েছেন’ শুনে কথা ঘুরিয়ে বলেছেন, ‘‘কানাইয়া তো কালোই। ভালই হয়েছে।’’

কিন্তু এই অঙ্ক এতই সরল কি? দাড়িভিটের ছাত্রমৃত্যু ঘিরে তৈরি অসন্তোষ রাজনীতির হাত ধরেই ছড়িয়েছিল। সেই সঙ্গে পঞ্চায়েত ও পুরসভার ভোটে মনোনয়ন থেকে শুরু করে ভোট পর্যন্ত তৃণমূলের বিরুদ্ধে গাজোয়ারি, মারামারি, হিংসার অভিযোগও জোরালো। শুধু তাই নয়, লোকসভা নির্বাচনে নিরাপত্তার দাবিতে ভোটকর্মীদের যে বিক্ষোভ হয়েছে তার উৎসও রায়গঞ্জ। পঞ্চায়েত ভোটের দিন এখানেই মারা গিয়েছিলেন প্রিসাইডিং অফিসার রাজকুমার রায়। এই সব মিলিয়ে তৈরি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতাও পার

হতে হবে তৃণমূলকে।

যে বিজেপি বিরোধিতায় তিন পক্ষের এই টানাটানি সেই বিজেপির অবস্থা কী? সাতসকালে এই প্রশ্ন করতেই রায়গঞ্জের নেতাজি পল্লির ছিমছাম বৈঠকখানা চুপ। সহকর্মীদের নীরবতা ভেঙে ‘কেশব ভবনের প্রিয়পাত্রী’ প্রার্থী দেবশ্রী চৌধুরীর জবাব, ‘‘চারদিকেই তো বিজেপি।

অন্য আর কেউ নেই। তাই এখানে লড়াইটাই নেই।”

রাজনীতিতেই দুইয়ের সঙ্গে দুই যোগ করলে পাঁচ হয়। সেই ব্যতিক্রমের সম্ভাবনাও দেখছে রায়গঞ্জ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE