Advertisement
১১ মে ২০২৪

জোৎস্নায় কাঁটাতারের উপর দিয়ে উড়ে আসে চাকতি

সীমান্তের অর্থনীতি এবং রাজনীতি, দুইই নিয়ন্ত্রণ করে পাচার। বখরায় সীমান্ত ভেদাভেদ নেই।

এই টাকা দেখিয়েই মেলে পাচারের ছাড়পত্র। —নিজস্ব চিত্র।

এই টাকা দেখিয়েই মেলে পাচারের ছাড়পত্র। —নিজস্ব চিত্র।

সুপ্রকাশ মণ্ডল
পাচারপাড়ায় শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৫০
Share: Save:

আদিগন্ত সবুজ গমখেত। মাঝে কাঁটাতার। ও-পার থেকে এ-পারের খেতে এসে পড়ল উড়ন্ত চাকতি। ‘উড়তা পঞ্জাব’ ছবির প্রথম দৃশ্য।

রাতবিরেতে উড়ন্ত চাকতি এখানেও এসে পড়ে। এখানে পাটের খেত। এটা নদিয়া। সীমান্তের নাম গেদে। গ্রাম গোবিন্দপুর।

ঝোপের আড়ালে রাতভর অপেক্ষায় থাকে সুফল বিশ্বাস (নাম পরিবর্তিত)। বিএসএফ জওয়ান সরলে এ পার থেকে মিস্‌ড কল যায়। ও পার থেকেও আসে। তার পরেই উড়ে আসে কাপড়ের পুঁটলি। পুঁটলি খুলতেই পূর্ণিমার আলোয় চকচক করে ওঠে— সোনা।

সীমান্তের অর্থনীতি এবং রাজনীতি, দুইই নিয়ন্ত্রণ করে পাচার। বখরায় সীমান্ত ভেদাভেদ নেই।

সেটা ছিল আশির দশক। সীমান্তে সব জায়গায় তখনও কাঁটাতার পড়েনি। আচমকা গরু পাচার প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সীমান্তের গ্রামের বাসিন্দাদের হাতে প্রচুর টাকা। বাড়ি পাকা হয়, কাঁচা রাস্তা জুড়ে দাপাদাপি বাড়ে মোটরবাইকের। উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন এলাকায় মানুষের হাতে এত টাকা কী করে আসছে, তা ধরতে বছর পার হয়ে গিয়েছিল পুলিশ-বিএসএফ-এর। জানা যায় ও পার থেকে সোনা চালান হচ্ছিল এ পারে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সোনা পাচার প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

গেদের বানপুর, পুটিখালি, গোবিন্দপুর, আদিত্যপুর তো বটেই উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরের সীমান্ত জুড়েও এখন শুধু সোনা পাচারের রমরমা। গত কয়েক মাসে এই দুই জেলায় পাচার করার সময়ে বিস্তর সোনা ধরা পড়েছে।

গেদে এলাকার বাসিন্দা বিকাশ হালদার জানান, আগে বিমানে করে সোনা ঢুকত। সেখানে বেজায় কড়াকড়ি। তাই সীমান্ত দিয়েই চলছে পাচার। যাঁরা পাচারে জড়িত, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সোনার কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন মাজদিয়া, গেদে এবং বানপুরের তিন কারবারি।

মুর্শিদাবাদের সীমান্তে আবার চলে গরু আর ‘ডিল’ চালাচালি। নাম তার একটা আছে বটে, যাকে বলে ব্র্যান্ড নেম। কিন্তু এখানে তার নাম ‘ডিল’। না, এ ডিল কোনও চুক্তি নয়। নেহাতই কাশির সিরাপ। তাকে নিয়েই যত কাণ্ড।

গ্রীষ্মের দগ্ধ দুপুরে তখন চরাচর পুড়ছে। দিগবলয়ে নজরে পড়ে বিএসএফ-এর নজরমিনার। মাঝে পদ্মা। মুর্শিদাবাদে রানিনগরের বামনাবাদ যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সে কথা বলতেই হেসে ওঠেন গ্রামের বাসিন্দা ডালিম শেখ। “গাঁ আর কোথায়। ওই যে যেখানে এখন নদীর জল বইছে, ওটাই ছিল আমাদের বামনাবাদ।” কথায় কথায় জানতে চাই, “পাচার হয় না ও পথ দিয়ে?” ঝাঁঝিয়ে ওঠেন প্রবীণ লোকমান শেখ। “লুকোছাপার কিছু নাই কত্তা। জমি জিরেত সবই নদীগব্বে। পাচার ছাড়া আর তো কোনও উপায় দেখি না। কে দিবে দু’বেলা ভাত?” সাফ কথা তাঁর। বৃদ্ধ বলেন, “আমরা তো চুনোপুটি। ডিল আর গরু পাস করে ক’টাকা পাই? পাচারের আসল লোক তো বহরমপুর-ডোমকল-উমরপুরে বসে আছে। ওদের সঙ্গেই তো ভোটবাবুদের গলাগলি।”

সীমান্তের রাজনীতিকে পাচার কেমন করে নিয়ন্ত্রণ করে, বোঝালেন দিগম্বরপুরের প্রবীণ বাসিন্দা বিজন হালদার। জানালেন, যারা পাচার করে তাদের ‘পাসার’ বলে। তাদের উপরে রয়েছে আরও অন্তত দশ জন। আসল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের উপরের তিন বা চারজন বড় কারবারি। তারাই কিংপিন। পুলিশ থেকে বিএসএফ, রাজনীতিবিদ সকলকে তুষ্ট করেই তাদের কারবার। বিজনবাবুর বক্তব্য, ‘‘ধরা যাক সীমান্তে বিএসএফের কড়াকড়ি বাড়ল। তা হলে কেন্দ্রে যারা ক্ষমতায়, তাদের কপাল পোড়ে। আর যদি পুলিশ বেশি বাড়াবাড়ি করে, তা হলে পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে শাসক দলের উপঢৌকনে টান পড়ে। তার প্রভাব পড়ে ভোট বাক্সেও।’’

এর প্রমাণ রয়েছে যথেষ্ট। ১৯৯৮, ২০০৪ এবং সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি পঞ্চায়েত এলাকায় বিজেপি টেক্কা দিয়েছে। এ বারও স্বরূপনগরের কয়েকটি জায়গায় বিজেপির ফল ভাল হয়েছে। সারা জেলায় যখন তৃণমূলের জয়জয়কার, তখন সীমান্তে বিপরীত ছবি কেন? প্রশ্ন শুনে মুচকি হাসেন উত্তর ২৪ পরগনার শেফালি সরকার। বলেন, ‘‘সব প্রশ্নের তো উত্তর হয় না ভাই।’’ সত্যিই তো, আসলে সব প্রশ্নের উত্তর বোধহয় হতেও নেই। নিয়ম মেনে দিগন্তে সূর্য ডুবে যায়। এ পারের বিলের পাখিরা ও পারের গাছে ঠাঁই নেয়। চরাচর জুড়ে রাত নামে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE