Advertisement
০৬ মে ২০২৪
রাজ্য কমিটি

এক ঝাঁক তরুণ মুখ, তবু বজায় থাকল বৃদ্ধতন্ত্র

দল ক্ষমতায় নেই। সংগঠন শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে। এই পরিস্থিতিতে ‘নতুন প্রজন্মে’র ১৮ জনকে রাজ্য কমিটিতে এনে তারুণ্যের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করল আলিমুদ্দিন। তবে এখনই অবসান ঘটাতে পারল না ‘বৃদ্ধতন্ত্রে’র! রাজ্য সম্মেলনের আগেই বৃদ্ধতন্ত্রের অবসানের ডাক দিয়েছিলেন শারীরিক ভাবে অসুস্থ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। নিজেকেও রাজ্য কমিটি থেকে সরিয়ে নিয়ে পরামর্শদাতার ভূমিকায় রাখতে চেয়েছিলেন।

হাতে হাত। (বাঁ দিক থেকে) বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র এবং সীতারাম ইয়েচুরি। শুক্রবার সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে।—নিজস্ব চিত্র।

হাতে হাত। (বাঁ দিক থেকে) বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র এবং সীতারাম ইয়েচুরি। শুক্রবার সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনে।—নিজস্ব চিত্র।

প্রসূন আচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৫ ০৩:৩৯
Share: Save:

দল ক্ষমতায় নেই। সংগঠন শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে। এই পরিস্থিতিতে ‘নতুন প্রজন্মে’র ১৮ জনকে রাজ্য কমিটিতে এনে তারুণ্যের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করল আলিমুদ্দিন। তবে এখনই অবসান ঘটাতে পারল না ‘বৃদ্ধতন্ত্রে’র!

রাজ্য সম্মেলনের আগেই বৃদ্ধতন্ত্রের অবসানের ডাক দিয়েছিলেন শারীরিক ভাবে অসুস্থ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। নিজেকেও রাজ্য কমিটি থেকে সরিয়ে নিয়ে পরামর্শদাতার ভূমিকায় রাখতে চেয়েছিলেন। ৭৫ বছরের বিমান বসু সুস্থ থাকলেও ‘পদে না থেকে কাজ করা’র যুক্তি দেখিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত দু’জনেই রাজ্য কমিটিতে থেকে গেলেন। তবে সীতারাম ইয়েচুরি আর সূর্যকান্ত মিশ্রকে পাশে নিয়ে শুক্রবার বিমানবাবু ঘোষণা করলেন দলের নতুন নীতির কথা এখন থেকে ৬০ বছরের কম বয়সীদেরই রাজ্য কমিটির নতুন সদস্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এই পদ্ধতিতেই এক ঝাঁক নতুন মুখ রাজ্য কমিটিতে এসেছে। যাদের অধিকাংশের বয়স ৪০ বছরের আশেপাশে। রাজ্য কমিটি হয়েছে ৮১ জনের। পরে আরও তিন জনকে নেওয়া হবে।

পাঁচ দিন ধরে সম্মেলন করেও ৮০ বছরের বাসুদেব আচারিয়া, মিতালি কুমারদের বাদ দিতে পারেনি আলিমুদ্দিন। রঘুনাথ কুশারীকে সরিয়ে সত্তরোর্ধ্ব নিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়কে কলকাতা জেলার সম্পাদক করার পরে দলের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছিল, এটা কি পিছনে হাঁটা নয়? এ বার রঘুনাথবাবু, হুগলির সুনীল সরকার, পূর্ব মেদিনীপুরের প্রশান্ত প্রধান, ব্যারাকপুরের তড়িৎ তোপদার, মহম্মদ আমিনদের রাজ্য কমিটির ‘বিশেষ আমন্ত্রিত’ করা হয়েছে। সত্তরোর্ধ্ব মোরসেলিন মোল্লাকে আমন্ত্রিত সদস্য হিসাবে নেওয়া হয়েছে। সম্মান দেখাতে স্থায়ী আমন্ত্রিত হিসাবেই রেখে দেওয়া হয়েছে অসুস্থ নকুল মাহাতো, বিধানসভার প্রাক্তন স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিমকেও। অর্থাৎ এঁরা রাজ্য কমিটির বৈঠকে উপস্থিত থেকে মতামত দিতে পারবেন। যদিও কোনও বিষয়ে ভোট হলে তাতে অংশ নিতে পারবেন না।

প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন বেশ কিছু দিন ধরেই শারীরিক ভাবে অসুস্থ। তাঁকে রাজ্য কমিটির পূর্ণ সদস্য থেকে সরিয়ে স্থায়ী আমন্ত্রিত করা হয়েছে। কন্ট্রোল কমিশনের সদস্য হিসাবে বর্ষীয়ান কান্তি বিশ্বাসকে রেখে দেওয়া হয়েছে রাজ্য কমিটিতে। সব মিলিয়ে যা হয়েছে, তাতে দলীয় নেতৃত্বের একাংশ হতাশ। এক রাজ্য নেতার কথায়, “রাজ্য কমিটিতে বিমানদা, বুদ্ধদার গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু বাকিদের কেন রাখা হল? আরও নতুন মুখ কোথায়?”

দলেরই অন্য একাংশ অবশ্য বলছে, দীর্ঘদিনের প্রথা থেকে বেরিয়ে এ বার তারুণ্যের পথে যাওয়ার প্রাথমিক সূচনা হল। চিনের কমিউনিস্ট পার্টিতে প্রতি বার এক-তৃতীয়াংশ নেতা বয়সের কারণে সরে যান। এখানেও নতুন সদস্য হিসাবে অধিকাংশ তরুণ মুখ অন্তর্ভুক্ত করে একটা বার্তা দেওয়া হল। ভবিষ্যতে রাজ্য কমিটির প্রতিনিধি বাছার সময় জেলা নেতৃত্বও যাতে বয়সের দিকে খেয়াল রাখেন, সেই দিকে তাঁদের এগিয়ে দেওয়া হল। সিপিএমের এক রাজ্য নেতার কথায়, “নতুন যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মধ্যে অপূর্ব পাল, সমন পাঠক, দেবব্রত ঘোষ, সোমনাথ ভট্টাচার্য, পলাশ দাস, রূপা বাগচি, গার্গী চট্টোপাধ্যায়েরা সবাই ৪০ থেকে ৫০-এর মধ্যে। কমিটিতে ৪০-এরও নীচে আছে ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, সায়নদীপ মিত্রেরা। রাজ্য কমিটির নতুনদের মধ্যে সিংহ ভাগ মধ্যচল্লিশের, সাম্প্রতিক অতীতে কোনও দিন এমন হয়েছে?”

বিদায়ী সম্পাদক বিমানবাবু এ দিন বলেন, “কমিটিতে মহিলা, সংখ্যালঘু সব রকম প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়েছে।” কিন্তু এখানেও আবার প্রশ্ন তুলছে দলের একাংশই। গত লোকসভা নির্বাচন থেকেই রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটের সিংহ ভাগ পাচ্ছে তৃণমূল। সেখানে ৮১ জনের কমিটিতে মুসলিম মুখ ৭ জন। মহিলা ৯ জন। মুসলিম প্রধান জেলা মালদহ, উত্তর দিনাজপুর থেকে কোনও মুসলিম নেতা রাজ্য কমিটিতে নেই। এমনকী, উত্তর ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, বর্ধমান, বীরভূম, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা থেকেও কোনও সংখ্যালঘু প্রতিনিধি নেই। নতুন যে তিন জন সংখ্যালঘুকে নেওয়া হয়েছে, তাঁরা হলেন জলপাইগুড়ির জিয়াউল আলম, কোচবিহারের তমসের আলি এবং নদিয়ার প্রাক্তন জেলা সভাধিপতি মেঘলাল শেখ।

দল থেকে বহিষ্কারের আগে আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা বারবার সিপিএমে মুসলিম নেতৃত্বের অভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। এখন নতুন দল গড়ে সে কথাই রাজ্য জুড়ে প্রচার চালাচ্ছেন। এই পরিস্থিতে নতুন প্রজন্মের মুসলিম নেতাদের আরও বেশি করে রাজ্য কমিটিতে তুলে আনা উচিত ছিল বলে দলেরই একাংশ মনে করছে। পার্টি কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের নাম ঘোষণার পরেই এ দিন প্রাক্তন সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রী আব্দুস সাত্তার উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, তিনি পার্টি কংগ্রেসে যাবেন না। তাঁর নাম বাদ দেওয়া হোক। কেন যাবেন না, তার কোনও ব্যাখ্যা সাত্তার নেননি। দলীয় সূত্রে খবর, রাজ্য কমিটিতে মুসলিম প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে সাত্তার অসন্তুষ্ট।

দীর্ঘদিন ধরেই কলকাতা, বর্ধমান এবং উত্তর ২৪ পরগনা ঘিরে আলিমুদ্দিনের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষিত হয়। এ বার কিন্তু রাজ্য কমিটিতে প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে বর্ধমানকে পিছনে ফেলে দিল গৌতম দেবের জেলা। নতুন করে এই জেলার চার জন রাজ্য কমিটির সদস্য হয়েছেন। এঁরা হলেন সোমনাথ ভট্টাচার্য, পলাশ দাশ, মৃণাল চক্রবর্তী এবং গার্গী চট্টোপাধ্যায়। ভবিষ্যতে এই জেলা থেকে আরও এক জনকে নেওয়া হবে বলে ঘনিষ্ঠ মহলে গৌতমবাবু জানান। সব মিলিয়ে এই জেলার সদস্য সংখ্যা ৯ জন। এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সাংসদ তড়িৎবাবুকে রাজ্য কমিটির পূর্ণাঙ্গ সদস্য থেকে সরিয়ে আমন্ত্রিত করা হয়েছে। জায়গা হয়নি মানস মুখোপাধ্যায় বা সুভাষ মুখোপাধ্যায়দেরও। সম্মেলনেই প্রতিবাদ করে মানসবাবু এবং শিল্পাঞ্চলের আর এক নেতা রঞ্জিত কুণ্ডু পার্টি কংগ্রেসের প্রতিনিধি তালিকা থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তবে প্রকাশ্যে তাঁদের দাবি, রাজ্য কমিটির নতুন প্যানেলের সঙ্গে তাঁদের ওই সিদ্ধান্তের সম্পর্ক নেই।

কলকাতার রূপা, বর্ধমানের বিধায়ক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়েরা যেমন নতুন কমিটিতে স্থান পেয়েছেন, তেমনই পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি, জলপাইগুড়ির সলিল আচার্য, উত্তর দিনাজপুরের অপূর্ব পাল, দক্ষিণ দিনাজপুরের নারায়ণ বিশ্বাস, বাঁকুড়ার অজিত পতিকে স্বাভাবিক কারণেই রাজ্য কমিটিতে নিতে হয়েছে। পুরনো কমিটি থেকে যাঁরা বাদ গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম বাঁকুড়ার পার্থ দে, দার্জিলিঙের এস পি লেপচা, বীরভূমের দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়, বর্ধমানের রথীন রায়, পূর্ব মেদিনীপুরে কানু সাহু (লক্ষ্মণ শেঠের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত), বিমানবাবুর সাক্ষরতার কমিটির সঙ্গে যুক্ত সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং উত্তর দিনীজপুরের সুবীর বিশ্বাস। বিদায়ী রাজ্য কমিটির বৈঠকে এ দিন উত্তর দিনাজপুরের সুবীরবাবুও প্রতিবাদ করেছেন বলে সিপিএম সূত্রের খবর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CPM state committee prasun acharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE