Advertisement
১৯ মে ২০২৪
শাসকের আজ সব চাই

দখলের দায়িত্বে বশংবদ পুলিশ, বাইরের কর্মীরা

শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত উত্তর ২৪ পরগনার ডিএসপি পদমর্যাদার এক অফিসারের ডিউটি পড়েছে ভোটযুদ্ধের বিধাননগরে। শুক্রবার সল্টলেক পুলিশের সঙ্গে তিনি বুথ এলাকা চিনতে বেরিয়েছিলেন।

এঁরাও প্রহরী। ভোটের আগের দিন বিধাননগর উত্তর থানায়। ছবি: শৌভিক দে।

এঁরাও প্রহরী। ভোটের আগের দিন বিধাননগর উত্তর থানায়। ছবি: শৌভিক দে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৪৭
Share: Save:

শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত উত্তর ২৪ পরগনার ডিএসপি পদমর্যাদার এক অফিসারের ডিউটি পড়েছে ভোটযুদ্ধের বিধাননগরে। শুক্রবার সল্টলেক পুলিশের সঙ্গে তিনি বুথ এলাকা চিনতে বেরিয়েছিলেন। হঠাৎই করুণাময়ীর কাছে পানের দোকানের সামনে দেখতে পেলেন এক পরিচিত যুবক। পুলিশ অফিসার বিস্মিত, কারণ, জিনস, টি শার্ট আর স্নিকার্স পরা ওই যুবকের বাড়ি বিধাননগর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে, বাদুড়িয়ায়!

ডিএসপি জানতে চাইলেন, ‘‘কী রে, তুই এখানে কী করছিস?’’ একটুও অপ্রতিভ না হয়ে যুবকের উত্তর, ‘‘বুঝতেই তো পারছেন স্যার। আপনি যে কারণে এসেছেন, আমিও সেই জন্যই!’’ এর পর দু’জনেই হাসিতে ফেটে পড়লেন। নরম পানীয় ও পান খেতে খেতে নিচু গলায় আলোচনাও চলল দু’জনের বেশ কিছু ক্ষণ!

শুধু বিরোধীদের একাংশের অভিযোগ নয়, তৃণমূলের একাধিক সূত্রেরও খবর, শাসক দলের অনুকূলে ‘ভোট করাতে’ এক দিকে যেমন দূর-দূর থেকে বহিরাগতদের এনে জড়ো করা হয়েছে, তেমনই বাছাই করে আনা হয়েছে পুলিশ অফিসারদেরও! নির্বাচনী কৌশলের অঙ্গ হিসেবে বাইরে থেকে বাছাই করে আনা পুলিশদের নির্দিষ্ট ডিউটি বাঁটোয়ারা করার পাশাপাশি বহিরাগতদেরও কর্তব্য বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

যেমন, পানিহাটি থেকে আসা পঞ্চাশ জনের একটি দলকে ভাগ করা হয়েছে পাঁচ ভাগে। প্রতিটি ভাগের মাথায় রয়েছে এমনই এক জন কট্টর কর্মী, যার সঙ্গে ভোট চলাকালীন মোবাইলে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবে পার্টি অফিস। যাতে যখনই যেখানে দরকার হবে, তখনই সেখানে ওই বাহিনীকে পাঠিয়ে দেওয়া যায়।

অভিযোগ উঠেছে, ভোট করাতে বহিরাগত ও অনুগত পুলিশ অফিসারদের উপর ভরসা করার পাশাপাশি এক দল সরকারি কর্মীও শাসক দলের নির্ভরতার জায়গা। কোন ওয়ার্ডের কোন বুথে পিছিয়ে থাকার আশঙ্কা আছে, সেই হোমওয়ার্ক করার পরেই ওই ‘বিশ্বস্ত’ ভোটকর্মীদের সেখানে ডিউটি দেওয়া হয়েছে! শাসক দলের পার্টি অফিসে তারও তালিকা রয়েছে বলে মানছেন অনেকেই।

ভোট করানোর নিপুণ পরিকল্পনায় বিরোধীদের একাংশ হারার আগেই হেরে গিয়েছে বলে মনে করছেন শাসক দলের নেতাদের একাংশ। কিন্তু ‘অবাধ ভোটের’ পথে সংবাদমাধ্যম প্রতিবন্ধক হয়ে উঠতে পারে বলে তাঁদের আশঙ্কা। বিধাননগরের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা প্রাক্তন চেয়ারপার্সন অনিতা মণ্ডল শুক্রবার কয়েক জন সাংবাদিক-চিত্র সাংবাদিককে বলেন, ‘‘শনিবার ফোন করে তবেই আসবেন! হুটহাট চলে আসবেন না!’’

রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় শুক্রবার বলেন, ‘‘বিধাননগরের পুরভোটকে কেন্দ্র করে প্রচুর অভিযোগ আসছিল। বিশেষ করে বহিরাগতরা বিপুল সংখ্যায় এসেছে বলে অভিযোগ ছিল। সিপিএম অভিযোগ করে, বাইরে থেকে লোক এনে কৈখালিতে, ভিআইপি রোডের ধারে একটি ধর্মীয় ভবনে রাখা হয়েছে।’’ সুশান্তবাবু জানান, ওই সব অভিযোগের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশনের একটি দল সেখানে পাঠানো হয়। তাঁরা প্রাথমিক রিপোর্টে জানিয়েছেন, ওখানে কিছু লোক এসে উঠেছিল ঠিকই, তবে শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে তারা সবাই চলে গিয়েছে। সুশান্তবাবু আরও জানান, সিপিএম থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল যে, বিধাননগর কমিশনারেট এলাকার নয়টি গেস্ট হাউসে বহিরাগতরা আশ্রয় নিয়েছে। তিনি পুলিশ কমিশনার জাভেদ শামিমকে নির্দেশ দিয়েছেন ওই গেস্ট হাউসগুলিতে সত্যিই সন্দেহভাজন লোক থাকলে ব্যবস্থা নিতে।

নির্বাচন কমিশনারের কথায় অবশ্য বিরোধীরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না। তাঁদের অভিযোগ, ওই সব জায়গা থেকে সরে বহিরাগতেরা কিছু গেস্ট হাউস, অনুষ্ঠান ভবন, হোটেল, বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে এবং মিস্ত্রির ভেক ধরে নির্মীয়মাণ কিছু বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। শুক্রবার মাঝরাতে তারা এলাকায় ঢুকবে ভোট করাতে! প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘সল্টলেকের ১৪টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে শাসক দল আড়াই হাজার করে লাঞ্চ প্যাকেটের অর্ডার দিয়েছে। এলাকায় যে বাইরে থেকেও লোক ঢুকেছে, সেটা এই সংখ্যা থেকেই বোঝা যেতে পারে!’’ গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বেদিক ভিলেজ কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত গফ্ফর, টালিগঞ্জের শেখ বিনোদ, ভাঙড়ের আরাবুল ইসলামের শাগরেদ শেখ রজ্জাক, ভজাই বাহিনী, হাতকাটা দিলীপের দল, নি‌উ টাউনের হাজি বাচ্চুর সাঙ্গোপাঙ্গরা ভোট লুঠ করতে ইতিমধ্যেই ঢুকে পড়েছে বিধাননগরে।

দত্তাবাদ এলাকায় ভোটের দু’দিন আগে থেকেই উধাও হয়ে গিয়েছে বিরোধীদের ব্যানার-পতাকা। স্থানীয়রা ভয়ে ভয়ে বলছেন, ‘ওরা সব খুলে নিয়ে গিয়েছে’! ওরা কারা? সে প্রশ্নের অবশ্য জবাব মেলেনি।

বহিরাগতদের ঠেকানোর চেষ্টায় এ দিন রাতে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে লাঠিসোটা নিয়ে রাতপাহারায় পথে নেমেছেন ডিওয়াইএফআই কর্মীরা। তবে বহিরাগতদের থেকে শাসক-ঘনিষ্ঠ পুলিশই বেশি চিন্তা বিরোধীদের। সিপিএমের রাজারহাট আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক শুভজিৎ দাশগুপ্তর কথায়, ‘‘তৃণমূলের বহিরাগত গুন্ডা নিয়ে আমাদের ভয় তো আছেই। কিন্তু আরও বেশি ভয় বহিরাগত বেশ কয়েক জন পুলিশ অফিসারকে নিয়ে! তাঁদের আনাই হচ্ছে শাসক দলের ভোটলুঠ নিষ্কণ্টক করার জন্য!’’

পুলিশ সূত্রেরই খবর, একদা উত্তর ২৪ পরগনার একটি থানার ওসি, বর্তমানে এক ডিআইজি-র দফতরে বহাল এক ইনস্পেক্টর শনিবার ভোটের ডিউটি করবেন নিউ টাউনে। থানার ওসি থাকাকালীন ওই ইনস্পেক্টরের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি অন্যান্য এলাকায় ডাকাতি করে বেড়ানো এক দল দুষ্কৃতীকে আশ্রয় দেন! বিনিময়ে পান তাদের কাছ থেকে লুঠের বখরার ভাগ ও নিজের থানা এলাকায় ডাকাতি না-করার গ্যারান্টি! রাজ্যে পালাবদলের পর ওই ইনস্পেক্টর শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।

শাসক দলের একই রকম ঘনিষ্ঠ, ব্যারাকপুর কমিশনারেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ থানার ওসি-কে আজ রাখা হচ্ছে রাজারহাট-নারায়ণপুরে। ওই কমিশনারেটেরই আর এক জন ওসি থাকবেন বাগুইআটি-কেষ্টপুরে। এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘বাগুইআটি থানার অফিসারদের একাংশের সঙ্গে রাজ্যের এক মন্ত্রী ও শাসক দলের এক সাংসদের সম্পর্ক ভাল নয়। বাগুইআটি এলাকার ওয়ার্ডগুলিকে স্থানীয় পুলিশ অফিসারদের হাতে ছাড়তে ভরসা করা যাচ্ছে না। সেই জন্যই ব্যারাকপুর কমিশনারেট থেকে আনা হয়েছে।’’

বিধাননগরে আজ, শনিবার ২১৩৫ জন পুলিশ মোতায়েন করা হচ্ছে। এর মধ্যে বিধাননগর কমিশনারেটের অর্থাৎ স্থানীয় পুলিশ প্রায় ১৪০০। বাকি ৭৩৫ জন পুলিশ অফিসার ও কর্মী আসছেন বাইরে থেকে। আর বহিরাগত অফিসারদের একটা বড় অংশকে শাসক দল রীতিমতো বাছাই করে ভোটের ডিউটি দিয়েছে বলে পুলিশ সূত্রেরই খবর। এক বর্ষীয়ান পুলিশ অফিসার বলেন, ‘‘শাসক দলের জেতা নিয়ে যেখানে সংশয় নেই, সেখানে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করার সুনাম আছে, এমন পুলিশ অফিসারদের রাখার কথা। আর যেখানে বিরোধীরা টক্কর দিতে পারে, সেখানে একযোগে বশংবদ পুলিশ অফিসার ও বহিরাগতদের দিয়ে ভোট করানোর ছক তৈরি হয়েছে।’’

কিন্তু এর ফলে বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশের একাংশ ক্ষুব্ধ। এক ইনস্পেক্টরের কথায়, ‘‘এত বছর ভোটের ডিউটি করছি, কিন্তু এই ভাবে অপমানিত হতে হয়নি! বেশ কয়েক বছর কাজ করার সুবাদে আমরা বিধাননগর পুর এলাকার গলিঘুঁজি জানি। অথচ শুক্রবার বিকেলেও আমাদের বলা হয়নি, শনিবার ঠিক কী দায়িত্ব পালন করতে হবে!’’ যদিও বহিরাগত পুলিশকে দিয়ে ‘ভোট করানোর’ অভিযোগ মানতে নারাজ বিধাননগর কমিশনারেটের কর্তারা।

প্রশাসন সূত্রের খবর, বশংবদ পুলিশ ও প্রিসাইডিং অফিসারদের মোতায়েন করে ভোট লুঠের এক অভিনব ছক কষা হয়েছে। বহু বুথে ভোর চারটে থেকে ছ’টার মধ্যে, ‘মক পোলিং’ বা ভোটযন্ত্র পরীক্ষার সময়েই ২০ শতাংশ ভোট ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছেন নেতারা। প্রশাসনের একাংশের দাবি, কারচুপির এই ‘মডেল’ অনুসরণ করে সাম্প্রতিক অতীতে বসিরহাট, বারাসতের মতো এলাকায় সাফল্য এসেছে।

আবার বাইক বাহিনীর দাপট নিয়ে অভিযোগ ও হইচই হওয়ার ফলে ভোটের দিন বিতর্ক এড়াতে সল্টলেকের কয়েকটি ওয়ার্ডে বেশি সংখ্যায় সরকারি বাস নামানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ওই সব বাসেই বুথ দখল ও ছাপ্পা ভোট দেওয়ার ‘বাহিনী’ থাকবে বলে পুলিশ সূত্রেই জানা গিয়েছে। তবে তৃণমূলের একটি সূত্রের খবর, বুথ দখল করা ও ছাপ্পা ভোট দেওয়া— দু’টো কাজের বাহিনী কিন্তু আলাদা।

যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘বিরোধীরা ভিত্তিহীন প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। কোনও রকম গোলমাল হবে না। শান্তিপূর্ণ ভাবে ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন। বিরোধীরা গোলমাল পাকানোর চেষ্টা করছেন। তারা গোলমাল করলে আমরা মোকাবিলা করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE